ঢাকা, ০৭ জুলাই, ২০২৫ || ২২ আষাঢ় ১৪৩২
Breaking:
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল      যুদ্ধের পর প্রথমবারের প্রকাশ্যে এসে ‘হে ইরান’ গাইতে বললেন খামেনি      সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ বলে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  জামায়াত একদিকে মনোনয়ন দিচ্ছে, আরেক দিকে ভোট পেছানোর দাবি করছে : রিজভী        সবার আগে বিপদে পড়বে জামায়াত, তারপর বিএনপি : রনি     
১৬৩৭

বলাই বাহুল্য সেই গবেষণার টেস্ট কেস অবশ্যই পাকিস্তান

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)ঃটিভির চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎই চোখে পড়ল রাওয়ালপিন্ডি টেস্ট। মাঠে খেলছে বাংলাদেশ, কিন্তু আমার কাছে মনে আরও বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছিল গ্যালারির খেলা। সেখানে বাংলা বর্ণমালায় লেখা একটা ব্যানার হাতে নেচে-গেয়ে উল্লাস করছে কিছু কাবুলি পোশাক পরা পাকিস্তানি দর্শক। ব্যানারে লেখা ‘স্বাগতম বাংলাদেশ’। আনাড়ি হাতে আঁকা ছোট একটা লাল-সবুজ পতাকাও আছে ব্যানারটিতে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের বিশাল বড় গ্যালারিতে ছোট্ট ওই ব্যানারটা আমাদের জন্য বড় একটা উপহাস। আবার এও মনে হচ্ছিল এটাই তো পাকিস্তান। এই হটকারীতাই তো ওদের জাতীয় চরিত্র।


ইতিহাসের যারা ছাত্র, আমার মতো চিকিৎসকের কাছ থেকে যাদের ইতিহাসের পাঠ নেয়ার প্রয়োজন নেই, তারা খুব ভালোই জানেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে জাতিতে-জাতিতে সংঘাত আর রক্তক্ষরণ ইতিহাসে কোনো নতুন কিছু না। শিয়ার হাতে রক্ত ঝরবে সুন্নির কিংবা ব্রাহ্মণের হাতে শুদ্রর, একই ধর্মের নানা ধারার মধ্যে এমনই ধরনের সংঘাতের উদাহরণও ইতিহাসে ভুরি-ভুরি। কিন্তু সুন্নির হাতে মারা পড়ছে সুন্নি আর ধর্ষিত হচ্ছে সুন্নি নারী, একই ধর্মের একই ধারার মধ্যে এমন উদাহরণ পৃথিবীতে করে দেখিয়েছে এই পাকিস্তানিরাই, তাও একবার নয়, দুবার নয়, বহুবার।


একাত্তরে ধর্মের নামে পাকিস্তানিদের হাতে বাংলাদেশে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। কিন্তু এটাই প্রথম নয়। ১৯৪৭-এ বেলুচিস্তানকে গায়ের জোরে নিজের মানচিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল পাকিস্তান যা আজও মেনে নেয়নি বেলুচিরা। বাঙালিকে শায়েস্তা করতে যে জেনারেল টিক্কা খানকে এদেশে পাঠানো হয়েছিল তার আরেক নাম ছিল ‘বেলুচিস্তানের কসাই’। এদেশে আসার আগে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে নৃশংসভাবে গুড়িয়ে দেয়ার সাফল্যেই টিক্কা খানের কপালে জুটেছিল অমন তকমা।


আজও যখন রাওয়ালপিন্ডিতে চলছে পাকিস্তান-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ, তখন পাশাপাশি সমান তালে চলছে বেলুচিস্তানে পাকিস্তানিদের দমন-পীড়ন। এখনও বেলুচিস্তানে ইন্টারনেট নিষিদ্ধ আর মোবাইলের ব্যবহার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। সেখানে এখনও কোনো এনজিও কিংবা মানবাধিকার সংগঠনকে কাজ করতে দেয়া হয় না। পাকিস্তানের সমালোচনা করায় এই ক’দিন আগেই গ্রেফতার হয়েছেন বেলুচিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা মঞ্জুর পাশতিন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্রমাগতই অভিযোগ করে চলেছে যে, আফগানিস্তান থেকে তার দেশে নাকি সন্ত্রাসবাদ রফতানি করা হচ্ছে। অথচ এই ইমরান খানই তার পূর্বসুরীদের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে ভারতীয় সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।


সম্প্রতি ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নিলে আমরা নানা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে পাকিস্তানকে এ নিয়ে গলা ফাটাতে দেখেছি। তারা বিষয়টিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। এই ক’দিন আগেও দাভোসে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনেও ইমরান খান সম্মেলনটির মূল আলোচ্যসূচিকে পাশ কাটিয়ে এই প্ল্যাটফর্মটিকে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। অথচ প্রতিবেশী দেশের উইঘুর মুসলামানদের প্রতি নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের মুখে কুলুপ আটা। প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলা নাকি তাদের শিষ্টাচারে পড়ে না। অথচ আফগানিস্তান কিংবা ভারতের মতো প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবকিছু করাই তাদের রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের তালিকায় একেবারে শুরুর দিকে। এমন অদ্ভুত দ্বিচারিতার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।


বিরোধী দলে থাকার সময় পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ কাশ্মীরের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে ১৯৯০-এর ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানব্যাপী হরতাল ডেকেছিল। সেই থেকে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে কাশ্মীর দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর প্রতি বছরই এই দিনটিতে পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয় জঙ্গিরা প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করে আসছে। গত বছরও ৫ ফেব্রুয়ারি মাসুদ আজহার আর সাঈদের মতো জঙ্গি নেতারা রাজপথে আবির্ভূত হয়েছিল যাদের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাকিস্তান সমর্থিত ও অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত যেসব সশস্ত্রগোষ্ঠী পাকিস্তান থেকে লাইন অব কন্ট্রোলের ওপারে ভারতীয় কাশ্মীরে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের অন্যতম একটি সংগঠনের নাম ‘আলবদর’। কোনো মিল কি খুঁজে পাচ্ছেন?


এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে আর বৈষম্যমূলক আচরণ অবশ্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সকল স্তরেই। জানি না আপনাদের কারও আসিয়া বিবির কথা মনে আছে কিনা? ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এই নারীকে ২০১০ সালে পাকিস্তানি আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। আসিয়ার পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসিরকে খুন করেছিল তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরী। একই সময় খুন হন পাকিস্তানের আরেকজন প্রাদেশিক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও। তার অপরাধও ছিল একই। আর ওই যে মুমতাজ কাদরী, গভর্নর সালমান তাসিরের খুনি, সে এখন পাকিস্তানে পরম পূজনীয় একজন ব্যক্তি।


প্রায় ন’বছর কারাগারে আটক ছিলেন আসিয়া। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেন। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল পাকিস্তানের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এমনকি থানা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছিল তখন। আসিয়া বিবি এখন কানাডায় আত্মগোপনে আছেন। পাকিস্তানের কারাগারে নয় বছরের কারাবাসের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে লেখা তার বই এনফিল লিব্রে (অবশেষে মুক্তি) একসময় বেস্ট সেলার হয়েছিল।


এই সেদিনও বাংলাদেশ যখন উহানে আটকেপড়া তিনশ’রও বেশি নাগরিককে বিশেষ বিমান পাঠিয়ে দেশে উড়িয়ে নিয়ে আসল তখন বেইজিংয়ের পাক দূতাবাসের খবর জানেন তো? বেইজিংয়ে তাদের দূতাবাস চীনে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে যেহেতু মানুষের মৃত্যু স্রষ্টার হাতে এবং মানুষের এ বিষয়ে করার কিছুই নেই, তাই পাকিস্তান সরকার তার নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগই নেবে না।


যে ভারতের বিরোধিতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পলিসি, কোথায় আজ সেই ভারত আর কোন তলানিতে পড়ে আছে তারা। যে বাংলাদেশকে একদিন তারা তলাবিহীন ঝুড়ি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল, আজ সেই বাংলাদেশ হওয়ার জন্য তাদের সুশীলদের কতই না আহাজারি। তাদের টকশোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন আলোচনা আর বিশ্লেষণের বিষয়। তারা আর সুইজারল্যান্ড হতে চায় না। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হতে পারলেই নাকি তারা খুশি।


রাওয়ালপিন্ডির গ্যালারিতে বাংলা ব্যানারটি দেখে আমার আসলে এখন পাকিস্তানিদের প্রতি করুণাই হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সন্ত্রাসবাদে রাষ্ট্রীয় মদত, একটা প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্রকে কোন ভাগাড়ে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা এই শুরু হলো বলে। আর বলাই বাহুল্য সেই গবেষণার টেস্ট কেস অবশ্যই পাকিস্তান।


লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
-অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।


মুক্তআলো২৪.কম

 

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত