ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
ঢাকায় ভিসা সেন্টার চালু করেছে চীনা দূতাবাস     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  স্বচ্ছতার সাথে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে : তথ্য প্রতিমন্ত্রী        বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী     
৬৫০

রতের সম্প্রীতি উৎসব:পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২২  

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়


ষড়ঋতুর বাংলায় শরতের একটি বিশেষ গন্ধ আছে যা অন্য আর পাঁচটি ঋতুর চেয়ে আলাদা। শরতের রূপেও আছে আলাদা মাধুর্য। নবীন চরের মত স্নিগ্ধ সুন্দর শরতের রূপ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নদী-নালা-খাল- বিলের পাড়ে পাড়ে  নরোম কাশবনের দুলনি। ভোরের আলোয় সবুজ ঘাষের ডগায় মুক্তোরমত উজ্জল শিশির বিন্দু। আর কমলা রঙের বোঁটায় মৃত্তিকালগ্নী অজস্র শুভ্র শেফালি। বাগানে থোকা থোকা স্থলপদ্ম। সকাল-সন্ধ্যা বাতাসে হালকা হিমেল পরশ। এসবই বাংলার গ্রামাঞ্চলে শরৎ ঋতুকে চিনিয়ে দেয়। কাউকেই বলে দিতে হয়না যে শরৎ এসে গেছে-অমল ধবল পালে লেগেছে উত্তর থেকে আসতে শুরু করা মধুর হাওয়া। 

বাংলার গ্রামের অবয়বে দিনে দিনে যতই শহুরে রং লাগুক, শত শত বছর ধরে এটাই শরতের পরিচিত রূপ। যা আজো প্রায় একই রকম আছে। এই চেহারা চোখে দেখতে পাওয়া না গেলেও বুকে ঠিকই টের পাওয়া যায়। বর্ষার জল নেমে যাওয়া শীর্ণ খালের ওপার থেকে বাতাসে ভেসে আসা সুবেহসাদেকে ফজরের আজান আজো অবিকল একই রকম ভাবে এপারের হৃদয় স্পর্শ করে। আবার সন্ধ্যারতির শংখ আর কাঁশরের মিশ্রিত ধ্বণি ওপারের হৃদয়ে আদিকালের মতই নাচন তোলে। এই বৈশিষ্ট পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি ! এরই মাঝে মহালয়ায় পূণ্য প্রভাত পেরিয়ে চলে আসে বাংলার আদি উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ষষ্টি, সপ্তমি, অষ্টমী আর নবমী পেরিয়ে বাংলার ঢাকের বাদ্যে চিরচেনা নদী বা খালের জলে প্রতিমা বিসর্জন। কটা দিন কেটে যায় একটা ঘোরের ভেতর। বছরান্তে এই ঘোর লাগাটা বুঝি নেশার মত হয়ে গেছে। এটাই বাংলার শাশ্বত রূপ। এটাই এই জনপদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাস। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পাড় ঘেঁষে যাদের চিরকালীন ঠিকানা তারা অর্থাৎ সর্বধর্মের বাঙালির গভীরতর বিশ্বাস থেকে স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণে বলতে পারে ধর্ম যারই হোক উৎসবটা আমার। পরপর দুই বছর কোন রকমে পূজা সম্পন্ন হয়েছে, উৎসব হয়নি। অতিমারি কোভিড মুর্তিমান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ’ বছরও দেশ সম্পূর্ন কোভিড মুক্ত নয়। তবে ভয় ভেঙ্গে গেছে। শেখ হাসিনার একক বিচক্ষনতায় প্রয়োজনীয় টিকা নিয়েছে শহর-গ্রাম সবখানের মানুষ। কোভিড-ডেঙ্গি মিলিয়ে দিনান্তে মৃত্যূর সংখ্যা যে শূণ্য তা নয়। কিন্তু ঐযে, নাই নাই ভয় হবে হবেই জয়। শারদ উৎসবের আনন্দ উল্লাসে মৃত্যূদূতকেও পরোয়া নেই যেন। 

এ বছর পুজা মন্ডপের সংখ্যা বেশী। তার মানে পুজার আয়োজনও বেশী। আয়োজন বেশী মানে জন সম্পৃক্ততা বেশী, অর্থ ব্যায় বেশী। ঢাকা-চট্রগ্রামসহ দেশের সবত্র বিপনীবিতানগুলোতে লোকে লোকারন্য। বেশী দাম হাকিয়ে দোকানীরা গত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। আর ক্রেতারাও পকেট উজার করে কিনছেন খুশীর সওদা। এ’বছর অনুষ্ঠিত ঈদের অনুষ্ঠান দুটিতেও দেখা গেছে একই চিত্র। এ বুঝি দ্ইু বছরের খামতি কড়ায় গন্ডায় পুষিয়ে নেয়া। ক’দিন আগে সংবাদপত্রে দেখলাম একজন প্রতিমা শিল্পী মুখভর্তি হাসি ছড়িয়ে বলছেন, তিনি এ’বছর একাই বাইশ খানা প্রতিমা গড়েছেন। মনে হ’ল যেন পূর্বের সকল রেকর্ড ব্রেক করেছেন তিনি এমনই ভাব। অথচ গত দুই বছর পাল পাড়ার শূণ্য উঠোন জুড়ে দৈন্যের করুণ চিত্র। টেলিভিশনে দেখেছি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম আধুনা লুপ্ত কিংবা লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ মেলাগুলো নাকি এবার ফিরে পাচ্ছে তার হারানো চেহারা। সাজ সাজ রব চারদিকে। পাবনা-সাতক্ষীরা ফরিদপুর-ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নদী এবং খালে নৌকা বাইচের হল্লোরের খবর দেখছি গনমাধ্যমে গত কিছুদিন যাবৎ। শংকা কাটিয়ে এই সব তো ভয়হীন চিত্তের বিজয়েরই দৃশ্যাবলী। এই তো, এটাই তো ভাটি বাংলার আদি চরিত্র। দু’বেলা মরার আগে না মরার দৃঢ়তা। যেন সকল দৃশ্য আর অদৃশ্য প্রেতাতœার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সবল উচ্চারনে বলা, হতে পারিস তোরা বলবান কিন্তু তার চেয়েও বলবান আমরা এ দেশের মানুষ। বাঙালির চরিত্রের চিরায়ত চেহারা তো এটাই। নইলে একাত্তরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্দ-খ্রীষ্টান একসঙ্গে কীভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। কিভাবেই বা সর্ব ধর্মের মিলিত রক্তস্রোতে ভেসে এলো মহা মুক্তির পবিত্র পদ্ম। 

তবু জয় করেও ভয় যায় না। গত চার পাঁচ দশক ধরে শারদ উৎসবকে ম্লান ও মলিন করতে অন্ধকারে হিস হিস শব্দ তুলে ছুটে বেড়ায় ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদের গোষ্ঠি। গত বছর শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালে কুমিল্লা-নোয়াখালি-চাঁদপুর সহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় অতর্কিতে যে অঘটনগুলো তারা ঘটালো তা কেবল দু:খজনক নয়, রীতিমত এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিরোধী। বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি এবং চরিত্র বিরোধী। তবে শংকার ব্যাপারটি হ’লো ক্ষমতাধর রক্ষকের প্রশ্রয়ে এইসব ঘৃণ্য অপকর্মগুলো ঘটেছে বলে শোনা যায়। এলাকার মানুষ যদি প্রতিবাদী না হয়, রক্ষাকারী হিসেবে এগিয়ে না আসে তবে পুলিশ, প্রশাসন তো অসহায় হবেই। 

প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এসব ক্ষেত্রে নিতে হবে সময়োপযোগি কার্যকরী ভূমিকা। অস্ত্রের বদলে অস্ত্র নয়, দাঁড়াতে হবে এই ভূমির দর্শনকে চিত্তে ধারণ করে। বলতে হবে ইতিহাসের গৌরবজ্জল ভূমিকার কথা। দৃশ্যমান করতে হবে সম্মিলিত ঐক্যের সর্বোত্তম দৃঢ়তা। দুর্বৃত্ত যেখানেই আঁচড় দেবে বা দেয়ার চেষ্টা করবে সেখানেই অতি দ্রুততার সাথে আক্রান্ত্রকারীকে প্রতিহত করতে হবে। আক্রান্তজন, সম্প্রদায় এবং যারা কেবল ধর্মীয় কারনে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে বলতে হবে, ভয়ের কিছু নেই, আমরা আছি। দেশটা মুক্তিযুদ্ধের পথেই আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন লালিত শুভবোধ সম্পন্ন বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই সম্ভব আশুরিক অপশক্তির বিনাশ। 

সবশেষে একটি গভীর সত্যকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আবহমান কাল ধরে এই গাঙ্গেয় উপত্যকা সব মতের এবং ধর্মের জনগোষ্টিকে সমানভাবে লালল করেছে পরম মমতায়। বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অংকুর তার ষড়ঋতুর বৈচিত্রময় আবহাওয়ায়, তার লেকায়ত ঐতিহ্যে। আর তাই, ধর্মীয় দর্শনের মানবিক ও সুকুমার বোধগুলি সর্বকালে সহজাতভাবেই আপন করে নিয়েছে বাঙালি সমাজ। যে কারনে আমাদের যুথবদ্ধ, মিলিত শক্তির সামনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে শত্রুর আক্রমন। অন্ধাকারের শত্রুরা বারবার তছনছ করতে চেয়েছে নানা পরিচয়ের ফুলের অনবদ্য এক বাগিচা, ছিন্ন করতে চেয়েছে শত শত বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বাঁধা বিনিসুতোর এক সুদৃশ্য মালা। বিশ্বের অনেক জাতির চেয়ে বাংলা ও বাঙালির এই সমাজ দর্শন তাই একেবারেই আলাদা এবং ঈর্ষনীয়। 

তবে ধর্মান্ধ অসুর শক্তির ষড়যন্ত্র এবং অতর্কিত আঘাত যে বন্ধ হয়নি তা গেল বারের পুজোর সময় আমরা দেখেছি। যখনই সুযোগ পায় তখনই হিং¯্র বিষধর নাগিনী এবং শৃগাল শকুনের দল বিপন্ন করতে চায় আমাদের শাশ্বত কালের সম্প্রীতির সাজানো বাগান। কিন্তু তারা জানেনা বাঙালির জাতীয়তার ইতিহাস চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতার এক অবিনাশী গল্প। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই ঘনিয়ে এসেছে অমানিশার কালো ছায়া, আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে তা প্রতিহত করেছি, সৃষ্টি করেছি নব ইতিহাস। তাই বারবার মনে করিয়ে দিতে চাই একটি ঐতিহাসিক সত্যকে, সেটা হ’ল সকল ধর্মাবলম্বির মিলিত বুকের রক্তে আমরাই রচনা করেছি নতুন ইতিহাস, বিশ্বের বুকে সৃষ্টি করেছি এক নতুন মানচিত্র। শত সহশ্র বছরেও যেন এই মানচিত্রের রঙ ও চরিত্র অনুজ্জল না হয় সেটাই হোক এবারের সম্প্রীতির উৎসবের প্রতিজ্ঞা।শরতের সম্প্রীতির উৎসব আনন্দময় হোক। সকলের কল্যান হোক। 


পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও 
আহবায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ




মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত