ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
রাঙ্গামাটির সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে ছয়জন নিহত, আহত-৭      কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের তালিকা চেয়ে হাইকোর্ট আদেশ     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মরিশাসের প্রতি আহ্বান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর        মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা: ওবায়দুল কাদের        থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা     
১২৪৩

কোভিড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ এবং ভ্যাকসিন মিক্সিং:

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ৩ মে ২০২১  

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল):

কোভিড নিয়ে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ভ্যাকসিন। ক’দিন আগেই লিখেছিলাম যে, মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া আর অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার মাধ্যমে আমরা কোভিডের রাশটা টেনে ধরতে পারি যার প্রমাণ আমরা এদেশেই দেখেছিলাম গত বছরের শেষে যখন কোভিডের নতুন রোগী শনাক্তের দৈনিক হারটা আমরা কয়েক সপ্তাহের জন্য নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম ৫ শতাংশের নিচে আর দেখছি এই মুহূর্তেও যখন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউটা বাংলাদেশে নিম্নমুখী।

তবে কোভিডকে পাকাপাকিভাবে বিদায় করতে চাই ‘পালগত প্রতিরোধ’, অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি। আর তা অর্জন করতে হলে ভ্যাকসিনের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে এর কিছু উদাহরণও আমরা দেখতে শুরু করেছি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইসরাইলে। এই দেশগুলো এরই মধ্যে তাদের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে এসেছে এবং এই তিনটি দেশেই এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে কোভিড। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রথম যে তিন কোটি মানুষ সেদেশে কোভিডের প্রথম ডোজটি নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ৬৮ জনকে ডোজটি নেয়ার পরও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তবে তাদের কারোরই মৃত্যু হয়নি। অন্যদিকে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পরে সেদেশে কাউকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়নি। একইভাবে দেশেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, এদেশে যারা কোভিডের টিকার প্রথম ডোজটি নিয়েছেন তাদের কেউ কেউ কোভিডে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষেরই হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি। আর যে ১৮ শতাংশের মতো মানুষকে টিকার প্রথম ডোজটি নেওয়ার পরও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে তাদের প্রায় কারোরই তেমন বড় কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। টিকার প্রথম ডোজটি নেওয়ার পর কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এদেশে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের। বাংলাদেশের মতোই অভিজ্ঞতা জাপান আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোরও। এক সময় যে যুক্তরাষ্ট্র ছিল কোভিড মৃত্যুতে চ্যাম্পিয়ন আজ তারাও কোভিডকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে ভ্যাকসিনের কল্যাণে। কোভিডে আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১৫ কোটির বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ৩৩ লাখ। কাজেই সার্বিক বিবেচনায় ভ্যাকসিনে লাভের পাল্লাটা যে অনেক বেশি ভারি তা তো বলাই বাহুল্য।
 

ভ্যাকসিন আমাদের লাগবেই। অথচ এমন একটা সময় এই লেখাটার অবতারণা যখন ভ্যাকসিন সঙ্কটে চিন্তিত বাংলাদেশ। ভারত থেকে হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেছে কোভিশিল্ডের সরবরাহ। স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। বিকল্প উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ আর চীনের সিনোফার্মকে। জানা গেছে আগামী মাসেই দেশে আসবে স্পুটনিক-৫-এর ৪০ লাখ ডোজ। সামনেই আমরা চীনের উপহার হিসেবে পেতে যাচ্ছি ৫ লাখ ডোজ সিনোফার্ম আর সঙ্গে কোভ্যাক্স কোয়ালিশনের মাধ্যমে ঈদের আগেই আসতে যাচ্ছে ফাইজারের ১ লাখ ডোজ টিকাও। দেশে স্পুটনিক-৫ আর সিনোফার্ম উৎপাদনের ব্যাপারেও অগ্রগতির খবর এখন ইথারে ইথারে।
 

ভ্যাকসিনের মজুদ যখন ফুরিয়ে আসছিল তখন প্রথম ডোজের কার্যক্রম কেন অব্যাহত রাখা হয়েছিল তা নিয়ে কথা বলেছেন অনেকেই। এর কারণটা কিন্তু স্পষ্টই। ব্রিটেনেও একই কাজ করা হয়েছিল। যেহেতু প্রথম ডোজ দেয়ার পর কোভিডে আক্রান্ত হলেও অন্তত রোগের তীব্রতা অনেক কমে যায়, বলা যায় হাসপাতালে ভর্তির আর আইসিইউর প্রয়োজনই পড়ে না, সে কারণেই প্রথম ডোজটি চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাতে অন্তত আরও বেশি মানুষকে আরেকটু ভাল রাখা যায়।

যা হোক, এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তেরো থেকে চৌদ্দ লাখ মানুষ, যারা কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজটি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু এখন তাদের দ্বিতীয় ডোজটি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের কি হবে? অনেকে বলতে চাচ্ছেন এমন ভ্যাকসিন দুর্যোগে পড়েনি বাংলাদেশ তো বটেই, সম্ভবত পৃথিবীর কোন দেশই। সুবিবেচনা আর সুবুদ্ধিপ্রসূত নয় যে এমন বক্তব্য তার বলার অপেক্ষা রাখে না। কোভিশিল্ডের ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশনটি দিয়েছিল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের যে বিশেষ কমিটিটি তার সদস্য ছিলাম আমি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজটি নেয়ার চার থেকে বারো সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজটি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এরই মধ্যে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে আর্টিকেলও প্রকাশিত হয়েছে যে, কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজটি ভাল কাজ করে যদি তা বারো সপ্তাহ পরে দেয়া হয়। পত্রিকা মারফত যতটুকু জানতে পারছি আগামী জুন-জুলাই নাগাদ ভারত থেকে আমরা আরও কিছু কোভিশিল্ড পেতে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে যারা এপ্রিলে এদেশে এই ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজটি নিয়েছেন তাদের কোন ঝামেলাই থাকছে না। কিন্তু বাকিদের কি হবে? কি হবে যদি আমরা জুন-জুলাইয়েও কোভিশিল্ড না পাই?

প্রথমে দেখা যাক আমাদের হাতে আগামী মাসে কোভিশিল্ডের জায়গায় কি ভ্যাকসিনগুলো আসতে যাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানিয়েছেন আমরা রাশিয়া থেকে পাব ৪০ লাখ ডোজ স্পুটনিক-৫ আর চীন থেকে উপহার হিসেবে আসবে ৫ লাখ ডোজ ভাইরো সেল। পাশাপাশি ১ লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা আসবে কোভ্যাক্স কোয়ালিশনের মাধ্যমে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশ এবং আজারবাইজানে এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজের সঙ্গে স্পুটনিক-৫-এর দ্বিতীয় ডোজ দিয়ে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছেন। এর আগে গত ডিসেম্বরে এস্ট্র্র্রাজেনেকা জানিয়েছিলেন যে, তারা মনে করেন তাদের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের সঙ্গে রাশিয়ার আরডিআইএফ-এর স্পুটনিক-৫ দ্বিতীয় ডোজের ব্যবহার করা গেলে তাতে মোটের ওপর কার্যকারিতা বাড়বে। আর এটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, কোভিশিল্ড হচ্ছে মূলত এস্ট্রাজেনেকার কোভিড ভ্যাকসিনটির ভারতীয় সংস্করণ।
 

পাশাপাশি ব্রিটেনে গত ফেব্রুয়ারি মাসেই শুরু হয়েছে কম-ভ্যাক নামে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এই ট্রায়ালে প্রথম ডোজে এস্ট্রাজেনেকা কিংবা ফাইজারের ভ্যাকসিন আর দ্বিতীয় ডোজে একই ভ্যাকসিন অথবা মর্ডানা কিংবা নোভাভ্যাক্সের ভ্যাকসিন দিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি ফ্রান্সের ড্রাগ রেগুলেটরি কর্র্তৃপক্ষ হাউট ডি লা সেন্টে ঘোষণা করেছে যে, তারাও সেদেশে যারা এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটি গ্রহণ করেছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজার বা মর্ডানার ভ্যাকসিনটি দিতে যাচ্ছেন। একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে জার্মানি আর সঙ্গে স্পেনের সিদ্ধান্তও তেমনটাই।
 

প্রশ্ন জাগছে, কি যুক্তিতে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রথম আর দ্বিতীয় ডোজে একেক ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ কেন দেয়া হয়। ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের কাজ হচ্ছে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ‘প্রাইমিং’ করা অর্থাৎ শরীরে কোভিডের বিরুদ্ধে এন্টিবডি এবং পাশাপাশি ইনেট ইমিউনিটি তৈরি করা। আর দ্বিতীয় ডোজটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমের কোভিড ঠেকানোর সক্ষমতটা বাড়িয়ে দেয়।
 

ভ্যাকসিন মিক্সিং-এর সুফল নিয়ে এরই মধ্যে কিছু ডাটাও আসতে শুরু করেছে। কম-ভ্যাক ট্রায়ালের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে ট্রায়ালটির প্রধান গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ ম্যাথিউ স্ল্যাপ জানিয়েছেন ইঁদুরে তাদের গবেষণার ফলাফল। তারা দেখেছেন দুই ডোজে এস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজারের ভ্যাকসিন ব্যবহার না করে ভ্যাকসিন মিক্সিং করলে তাতে ইঁদুরে কোভিডের বিরুদ্ধে বেশি ভাল ইমিউনিটি তৈরি হয়। ভ্যাকসিন মিক্সিং-এর উদাহরণ অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ ডানা মাজোর উদ্ধৃতি দিয়ে হেলথ লাইন জানাচ্ছে দুটি আলাদা ধরনের নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন মিক্সিং-এ ভাল ফল পাওয়া যায়।
 

কোভিড প্রতিরোধে পৃথিবীজুড়ে মূলত দুই ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের হাতের নাগালে যে ভ্যাকসিনগুলো আছে তার মধ্যে কোভিশিল্ড আর স্পুটনিক-৫ হলো এডিনো ভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন। অর্থাৎ শিম্পাঞ্জীতে ইনফেকশন করলেও মানুষের করোনা এমনি ধরনের এডিনো ভাইরাসকে জেনেটিক্যালি মডিফাই করা হয়েছে এই দুটি ভ্যাকসিনে। এই দুটি আদতে ডিএনএ ভ্যাকসিন। অন্যদিকে সিনোফার্মের ভাইরোসেল হচ্ছে ইনএক্টিভেটেড সার্স-কোভ-২ ভ্যাকসিন অর্থাৎ এতে আছে প্রোটিন।

অন্যদিকে ফাইজারের ভ্যাকসিনটি হচ্ছে এম-আরএনএ ভ্যাকসিন। জটিল এই কথাগুলোর সরল মানে এই যে, ডিএনএ ভ্যাকসিনগুলো শরীরে প্রয়োগ করলে সেগুলো মেসেঞ্জার-আরএনএ বা এম-আরএনএ-এর মাধ্যমে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি করে। অন্যদিকে এম-আরএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই বাড়তি ধাপটির প্রয়োজন পড়ে না। কাজেই মোটা দাগে বলা যায়, প্রথম ডোজে একটি ভ্যাকসিন আর পরের ডোজে অন্য ভ্যাকসিন ব্যবহার করলে তাতে কাজ না হওয়ার শঙ্কা নেই বললেই চলে। ভ্যাকসিন মিক্সিং-এ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, তবে সেটিও খুব বেশি বলে মনে হয় না।

 

কাজেই যে যতই কথা বলুক না কেন ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কম। আমি জানি সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। পুরো দেশের মতো আমরাও তাকিয়ে আছি তাদের দিকে। তবে তাদের সিদ্ধান্তটা সম্ভবত এমটাই হতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা।
 

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ,

গবেষক, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান


 



মুক্তআলো২৪.কম

 

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত