ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
রাঙ্গামাটির সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে ছয়জন নিহত, আহত-৭      কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের তালিকা চেয়ে হাইকোর্ট আদেশ     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মরিশাসের প্রতি আহ্বান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর        মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা: ওবায়দুল কাদের        থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা     
১৫১৭

সেনাকুঞ্জের টেরাকোটা ম্যুরাল : ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):একুশে নবেম্বর আমার পছন্দের একটি তারিখ। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে অক্টোবর যখন নবেম্বরে, তখন থেকেই হৃদয়ে এক অদ্ভুত স্পন্দন অনুভব করি। প্রহর গুনতে থাকি একুশ নবেম্বরের পরন্ত দুপুরে সেনাকুঞ্জে সশস্ত্রবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য একাত্তরের এই দিনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি নতুন ধাপে প্রবেশ করে। কারণ এ দিনই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণের সূচনা করে।
প্রতি একুশ নবেম্বর সেনাকুঞ্জে কিছু ছকে বাঁধা ধারাবাহিক আনুষ্ঠানিকতা থাকে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে তার জন্য নির্ধারিত পোডিয়ামটিতে দাঁড়ান। পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা আর তিন বাহিনীর প্রধানরা। সামরিক ব্যান্ডে বেজে উঠে, ‘আমার সোনার বাংলা... ...’। অতিথিরা যে যেখানে থাকেন দাঁড়িয়ে পড়েন সঙ্গে সঙ্গেই। জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা সামরিক ভঙ্গিতে অভিবাদন জানান জাতীয় পতাকা আর সঙ্গীতকে। আমরা যারা বেসামরিক অতিথি তারা অনেকেই সামরিক ব্যান্ডের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাই ‘আমার সোনার বাংলা ... ...’। সে যে কি এক গর্বিত অনুভূতি, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।


২০১৯ সালের ২১ নবেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় একটু ব্যতিক্রম ছিল। জাতীয় সঙ্গীতের পর পরই প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত সেনাকুঞ্জের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন ফিতা কেটে উদ্বোধনের চল চলে গেছে বললেই চলে। সব কিছুতেই এখন ডিজিটাল ছোঁয়া। প্রধানমন্ত্রী সুইচে চাপ দিতেই নেমে গেল পর্দা, উন্মুক্ত হলো দুটি বিশাল টেরাকোটা ম্যুরাল নতুন সেনাকুঞ্জের দুুপাশে। ডান পাশের ম্যুরালটা জুড়ে শুধুই বঙ্গবন্ধু। গর্বিত ভঙ্গিতে তর্জনী উঁচিয়ে ৭ মার্চে রেসকোর্সে ডাক দিচ্ছেন বাংলা আর বাঙালীর মুক্তির, এরই মাঝে যা স্বীকৃতি পেয়েছে একমাত্র ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যে। এমন বিশাল একটি বিষয়কে দেয়ালে ধারণ করে সেনাকুঞ্জ যে ধন্য, সন্দেহ নেই তাতে।

আমার অসম্ভব ভাল লাগার অনুভূতিটা অবশ্য অন্য আরও একটি কারণে এবং সেই প্রেক্ষাপটেই এই লেখার অবতারণা। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা আমাদের গর্বিত সন্তান। এদেশকে তারা দিয়েছেন অনেক কিছু। আমাদের লাল-সবুজের পতাকায় মিশে আছে তাদের রক্ত। আমাদের সার্বভৌমত্বের এই অতন্দ্র প্রহরীদের হাতে দেশটাকে দেখ-ভাল করার ভারটা তুলে দিয়ে আমরা ষোলো কোটি লোক শান্তিতে ঘুমাই। আমাদের অনেক বড় বড় স্থাপনা তৈরি হচ্ছে তাদের ঘামে। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ এমনি আরও কত কি! বলে-গুনে শেষ করা কঠিন। দেশ আর দশ তাই কৃতজ্ঞ এই সন্তানদের প্রতি। প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের বক্তব্যেও এর প্রতিফলন ছিল।

এটি যেমন সত্যি, তেমনি এটাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের সেনা বাহিনীরই কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে একদিন এই দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা কোনদিনও পূরণ হওয়ার নয় কোন কিছুর বিনিময়েই। আমরা পঁচাত্তরে হারিয়েছিলাম জাতির পিতাকে সপরিবারে। এই ক্ষতির হিসাব এ জাতি কোনদিনও মেলাতে পারবে না।

রাতে যখন ঘুমাতে যাবেন তখন একটি বার ‘জয়-পুতুল-ববি-টিউলিপ-পরশ-তাপস’ এই মুখগুলোকে একটু ঠা-া মাথায় স্মরণ করবেন। ভেবে দেখবেন তাদের একাডেমিক যোগ্যতা। আর হিসাব মেলাবার চেষ্টা করবেন তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতিকে এ পর্যন্ত কি কি দিয়েছেন। তার পর ভাবার চেষ্টা করবেন যে, ১৫ আগস্ট যদি শেখ কামাল-শেখ জামাল-শেখ মনিরা অকালে ঝরে না যেতেন, তাহলে এদেশ আজ কোথায় থাকতে পারত। ভুলে যাবেন না, তারাই কিন্তু তাদের রক্তের ধারাবাহিকতা।

কিছু পাপিষ্ঠ পূর্বসূরির অপরাধের দায় আজকের সেনাবাহিনীর ওপর বর্তায় না-এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি ঠিক ওপরের উল্লিখিত বাস্তবতাও। আমাদের সেনাবাহিনীর সব কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা সেনানিবাসের মাঝখানে নবনির্মিত সেনাকুঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ম্যুরালটি দেখে আমার মনে হয়েছে এর মাধ্যমে কলঙ্ক মোচন হয়েছে আমাদের মাতৃভূমির গর্বিত সন্তানদের। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সেনাবহিনী। তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নবনির্মিত সেনাকুঞ্জের আরেক পাশের দেয়ালে অন্য ম্যুরালটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলা আর বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্য। এটিও প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ হোঁচট খেলাম। এই ম্যুরালটির নিচের দিকে ডান পাশে ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গার যে মোটিমুটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তাতে দেখা যায় দুজন সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা বঙ্গললনা হিজাব মাথায় ধান ভাঙছেন। চিত্রকলায়, ফটোগ্রাফিতে, পাঠ্যবইয়ের পাতায় অঙ্কিত গ্রাম-বাংলার ছবিতে, নাটক-সিনেমা-নৃত্যকলায় আজীবন দেখে এসেছি শাড়ি পরিহিতা রমণীদের চিরায়ত মাতৃরূপ। আবহমান বাংলার লাজুক গৃহবধূদের ঢেঁকিতে পাড় দেয়ার সময় অঙ্গশোভিত তাঁতের ডোরা কাটা শাড়ির বিকল্প অন্যকিছু হতে পারে বলে আমরা মানতে রাজি নই। শিল্পাচার্য জয়নুল, পটুয়া কামরুল কিংবা কাইয়ুম চৌধুরীদের তুলির স্পর্শে যে শাড়ি পরিহিত গ্রাম বাংলার বধূদের চিত্র মানসপটে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে, তার সৌন্দর্য অপার।

আমাদের এই বাঙালী চোখ অন্যকিছু দেখতে চায় না। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ‘ও ধান ভাঙ্গিরে- ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া গানটি শুনলেও চোখে ভাসে লাল-নীল-হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গরমণীর সরল ও সহজি রূপ। যার তুলনা বিশ্বের অন্য কোন দেশ ও সমাজে নেই। এটা আমাদের ঐতিহ্য ও আবহমান জীবন-সংস্কৃতির অংশ। এতক্ষণ যা বলেছি, তা লোকজ সংস্কৃতির প্রতি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে। যে কেউ অন্য যুক্তি টানতেই পারেন। বলতে পারেন সমকালীন বাস্তবতার কথা। সমকালীন বাস্তবতাকে অস্বীকার করি না। তবে এ ব্যাপারেও আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে উপজীব্য করে যে সংষ্কৃতি বিকশিত হয়, তা সমকালের গ-ি ছাড়িয়ে চিরকালীন সত্য হয়ে উঠবেই।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত