ঢাকা, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
ঢাকায় ভিসা সেন্টার চালু করেছে চীনা দূতাবাস     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন অংশীদারিত্ব গঠন: প্রধানমন্ত্রী        ন্যাপ এক্সপো-২০২৪ উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর        যুদ্ধ ব্যয়ের অর্থ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার হলে বিশ্ব রক্ষা পেত: প্রধানমন্ত্রী        কাতারের আমীরকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয় ঢাকা বিমানবন্দরে     
১১১০

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস: কিছু খবর, কিছু ভাবনা

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২০  

অধ্যাপক  ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) :
পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় পর্যদুস্ত ভারতবর্ষ। বিহারে সে সময় মারাত্মক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। দাঙ্গায় বিপর্যস্ত বিহারের মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ডাকে সাড়া দেননি সিন্ধ ও পাঞ্জাবের সে সময়কার মুখ্যমন্ত্রীরা। সাড়া দিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবকসহ বিহারে গিয়ে ওখানকার মুসলমানদের বাংলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে। সেই বিহারীদেরই আমরা আজকে দেখি ঢাকার মোহাম্মদপুর আর মিরপুরে আর সৈয়দপুরসহ দেশের আরো কিছু জায়গায়। আজকের পাকিস্তানেও আছে তারা। বিশেষ করে করাচীতে আর বাদবাকী সিন্ধেও। পাকিস্তানে বসবাসরত বিহারের এসব অধিবাসীদের আজকের পরিচিতি মোহাজের হিসেবে।

ক’দিন আগে পাকিস্তান উদযাপন করল তার স্বাধীনতা দিবস। চৌদ্দ তারিখে গুলশানে পাকিস্তান হাইকমিশনে পতাকা উড়িয়ে অনাড়ম্বরভাবে নিজ দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দীকি। তুরস্কের আনাদুলু নিউজ এজেন্সির বরাতে জানা যাচ্ছে অনুষ্ঠানে জনাব সিদ্দীকি দু’দেশের সম্পর্ককে গভীরতর করার ওপর জোর দিয়েছেন। তার ভাষায় ‘অভিন্ন ধর্মীয় বন্ধনে’ আবদ্ধ এই দুই দেশ এরই মধ্যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের শীতলতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি এই সম্পর্ককে উষ্ণতর করে তোলায় চীনের মধ্যস্থতার উপর জোর দেন।

খবরটি নানা কারণেই আমার কাছে খুব আগ্রহ জাগানিয়া বলে মনে হয়েছে। ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনার তার দূতাবাস প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে কী বললেন তা নিয়ে আমার আগ্রহ সামান্যই। আমি আগ্রহী হয়েছি যে ধর্মীয় অভিন্নতার ওপর পাকিস্তানি হাইকমিশনার মহোদয় তার বক্তব্যে গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রতি তার রাষ্ট্রের ডবল স্ট্যান্ডার্ডে। একাত্তরে বাঙালি মুসলমানের মুসলমানি করাতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা এদেশে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল মানব ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ধর্মের নামে অধর্মের উদাহরণ আছে পৃথিবীতে ভুরিভুরি। কিন্তু মুসলমানের হাতে মুসলমানের এমন নিধনের উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। অথচ এজন্য পাকিস্তানকে আজ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরে থাক, রাষ্ট্রীয়ভাবে দুঃখ প্রকাশ করতেও আমরা কখনো দেখিনি। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সে দেশের ইসলামাবাদ পলিসি ইন্সটিটিউটের একজন গবেষক একটি লম্বা ইংরেজি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেটি আবার ছাপাও হয়েছে এদেশের একটি নামকরা ইংরেজি দৈনিকে, কী রুচিতে জানি না! প্রবন্ধটিকে ঐ গবেষক নারী অতীতের তিক্ততা ভুলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগোনোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, জোর দিয়েছেন এ ব্যাপারে চীনা মধ্যস্থতায় আর প্রশংসা করেছেন এ নিয়ে উদ্যোগী হওয়ায় তার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের।

বাংলাদেশকে ঘিরে যে স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানিদের এত আগ্রহ, তাদের সেই স্বাধীনতা দিবসটিকে এবারে ‘কালো দিবস’ হিসেবে উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন, এই লেখার শুরুতে যে বিহারীদের কথা লিখেছি পাকিস্তানে তাদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন মোহাজের কওমী মুভমেন্ট। সংগঠনটির এ সংক্রান্ত বিবৃতিটি পড়ে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। পড়ে বুঝেছি ১৯৭১ আর ২০২০-এর পাকিস্তানের মধ্যে ফারাকটা বিন্দুসম। আজও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া আর করাচীতে মোহাজেরদের ওপর ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে মুসলিম দমন চলছে তার প্রতিবাদেই মোহাজের কওমী মুভমেন্টের এই আহ্বান।

ক’দিন আগে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের বর্ষপূর্তিতে একটি লম্বা বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতি যে কেউ যে কোনো বিষয়ে দিতেই পারেন। আমাদের মুক্তচিন্তার বাংলাদেশে বক্তব্য দেয়ায় বাধা নেই। এজন্য সরকার বা পুলিশ পাকিস্তানের মত কারো টুঁটি চেপে ধরে না। তবে বিবৃতিটি পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বাকস্বাধীনতা আর ডিপ্ল্যোমেটিক ইমিউনিটির সুযোগ নিয়ে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে বন্ধুভাবাপন্ন একটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেভাবে কাদা ছুড়েছে তা কূটনীতি তো বটেই, কোনোরকম সভ্যতা বা ভব্যতার সংজ্ঞাতেই পড়ে না। পাকিস্তানের কাছ থেকে তেমনটি অবশ্য প্রত্যাশিতও নয়। তবে আমি অবাক হয়েছি কাশ্মীরি মুসলমানদের প্রতি তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডে। কারণ এই কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের সময়েও পত্রিকা মারফত আমরা জেনেছি, কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের হাসপাতালগুলোয় রেফার করা হয়েছে যাতে কাশ্মীরের যা হয় হোক, অবশিষ্ট পাকিস্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

মুসলমানদের প্রতি ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের এই ডবল স্ট্যান্ডার্ড যে শুধু নিজ দেশের বেলাতেই নয় এটি প্রযোজ্য পৃথিবীর তাবৎ মুসলমানদের বেলাতেও। যে কারণে বাঙালি মুসলমানের নির্যাতন আর হত্যা কোনো বিষয় নয়। ‘বাংলার কসাই’ জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর ভাতিজা পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজী তাই তার অনাহুত টেলিফোন সংলাপে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দু’দেশের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেয়ার নির্লজ্জ আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করেন না। চীনের শিংজিয়ান প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে যে নজিরবিহীন নির্যাতন – রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উইঘুর নারীদের স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ, পুরুষদের শ্রমশিবিরে প্রেরণ, আর মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার যত বয়ান বিশ্ব মিডিয়ায়, পাকিস্তানীদের কর্ণকুহর ভেদ করার সাধ্য সেসবের কোথায়? এমনকি চীনা সমর্থনপুষ্ট মায়ানমারের সরকারি বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে বর্বরোচিত নির্যাতন, সে বিষয়ে জাতিসংঘের টেবিলে আলোচনা তোলায় যে চীনা প্রতিবন্ধকতা, সেখানেও নীরব পাকিস্তান। কেন যেন তাদের প্রাণটা শুধু কাঁদে জম্মু-কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য আর তাদের যত চেষ্টা সেই ’৭১ থেকেই বাঙালিকে আরো ভালো মুসলমান বানানোয়।

চীনের মধ্যস্থতার যে আহ্বান পাকিস্তানি সরকার আর বুদ্ধিজীবীদের, আমি নিশ্চিত তাতে সাড়া পাওয়া যাবে। এর সাক্ষ্য আছে ইতিহাসেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তার মৃতদেহ টুঙ্গিপাড়ায় দাফনের আগেই ভুট্টো সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সাথে ছিল পাকিস্তানের বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভুট্টোর ভাষায় ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে’ স্বীকৃতিদানের আহ্বানও। সেবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সে আহ্বানে চীন সাড়া দিয়েছিল দু’সপ্তাহের মধ্যে। পত্রিকা মারফত জেনেছি এবার পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তারা জন্মদিনের উপহার পৌঁছে দিয়েছেন বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদকে। উপহারগুলো অবশ্য পাকিস্তানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে নয়, ঐ রাজনৈতিক নেত্রীর ১৫ অগাস্টের স্বঘোষিত জন্মদিনের!

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
 

মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত