ঢাকা, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ || ৩ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে : তথ্য প্রতিমন্ত্রী        বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিকুলাম যুগোপযোগী করার তাগিদ রাষ্ট্রপতির     
১৫৯৫

ধর্ষণের রাজনীতিঃঅধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২০  

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
কোভিড-১৯ কে পাশ ঠেলে শিরোনামে যখন অন্য কিছু, কোভিডের জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পরা মানুষের কাছে তা মেঘ না চাইতে জলের মত হওয়াটাই ছিল প্রত্যাশিত। অথচ এক মহামারীকে ছাড়িয়ে ‘ধর্ষণ’ নামের অন্য মহামারীটি যখন শিরোনামে, তখন স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিটাই বেশী। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের জায়গায় মৃত্যুদণ্ড করে নন্দিত হয়েছেন মাননীয় সরকার প্রধান। গভীর রাতে চেম্বার থেকে ফিরে টিভি খুলতেই আল জাজিরার স্ক্রলেও চোখে পড়ল খবরটি।

বাংলাদেশের পজেটিভ ব্র্যান্ডিং-এ যারা একটু ‘কন্সটিপেটেড’ তারাও এ উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছে দেখে এতোসব ভাল না লাগার ভিড়েও একটুখানি ভালই লাগলো। কোভিড যেমন বহুমাত্রিক, বিজ্ঞান থেকে রাজনীতি, নির্বাচন থেকে অর্থনীতি সবকিছুতেই কোভিডের ছোঁয়া, এ যাত্রায় বুঝলাম ধর্ষণের বেলাতেও অনেকটা তাই। ধর্ষণের ডিকশনারিতে এবারের ‘ধর্ষণ প্যান্ডেমিকে’ সর্বশেষ সংযোজন ‘ধর্ষণের রাজনীতি’। রাজনীতি করেন কি করেন না, বোঝেন বা বুঝেও বোঝেন না এমন অনেকেই এবার জড়িয়েছেন এই রাজনীতিতে। আবার অনেকে দেরিতে মাঠে নেমে মিস করেছেন ট্রেন।

ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হয়েছিল ছাত্র সমাজ। সাথে-সাথে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ইত্যকার নানা পেশার মানুষও তাদের নিজ-নিজ অবস্থান থেকে, কখনো পথে নেমে আবার কখনো বা লেখায়-বলায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এমনটি আমরা ক’দিন আগেও দেখেছিলাম কোটা-বিরোধী আন্দোলন কিংবা তারও আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময়গুলোতে। দেখেছিলাম আরও অনেক বড় পরিসরে শাহবাগেও গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করেও। এবং বরাবরের মতই এবারও দেখলাম নিষ্কলুষ এই আন্দোলনগুলোকে ছিনতাইয়ের অপচেষ্টা। যেমন এবারে পোড়ানো হল মুজিব কোট, দাবি উঠলো ধর্ষকের বিচারের আগে সরকারের পদত্যাগের। আর সবচেয়ে যে ন্যাক্কারজনক, ধৃষ্টতা দেখানো হলো জাতির মুক্তির বাতিঘর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙ্গুল তোলারও।

একই ঘটনা ঘটেছিল কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময়টাতেও। ‘আমি রাজাকার’ লেখা টি-শার্ট গায়ে প্রতিবাদী তরুণের ছবি আর আওয়ামী লীগ অফিসে তরুণী ধর্ষণের গুজব ছড়িয়েছিল ফেইসবুকে। আর তারও আগে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের নামে স্কুল ড্রেস পড়া আদুভাইদের ছবিগুলোওতো কম ভাইরাল হয়নি। আমাদের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই ফেনোমেননটি মোটেও নতুন না। ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান তার সাম্প্রতিক একটি লেখায় মনে করিয়ে দিয়েছেন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময়কার কথা। সে সময়েও গভর্নর মোনায়েম খানের পেটোয়া ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর নেতারা ছাত্রদের এগারো দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বাইশ দফা প্রস্তাবনা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। সেদিন সেটি শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি, যেমনটি পায়না একালেও।

এভাবে যারা এই সামাজিক আন্দোলনগুলোকে বারবার নিজেদের স্বার্থে চুরি করার চেষ্টা করে তাদের একটা চরিত্র আছে। খেয়াল করলে দেখবেন, এদের মধ্যে কেউ-কেউ ‘আমি রাজাকার লেখা টি-শার্ট’ পরে কিংবা মুজিব কোট পুড়িয়ে আন্দোলনের নৈতিক জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আন্দোলনটা যে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে দানা বেধেছিল সেখান থেকে সরে গিয়ে বরং এই চক্রটির পক্ষ-বিপক্ষ কেন্দ্রিক হয়ে পরে।

এবারের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরুন। আমরা কি সুন্দর নূরু-দেলোয়ারদের কথা ভুলে গিয়ে কে, কোথায়, কী লেখা প্ল্যাকার্ড ঝোলালো কিংবা মুজিব কোট পোড়ালো তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় ব্যস্ত। এরাও ঠিক তাই-ই চায়। এরা চায় সমস্যাটা জিঁইয়ে থাকুক। ধর্ষণের অবসান এদের আদৌ কাম্য নয়। এরা বরং চায় ধর্ষণের বদলে যা কিছু বলা আর লেখার তা চলতে থাকুক তাদেরকে কেন্দ্র করে। তারা খুব ভালই জানে এসব ঠুনকো আন্দোলনে সরকারের পতন হয়না। কিন্তু সরকারের অস্বস্তিটা ক্রমাগতই বাড়তে থাকবে যদি চলতে থাকে ‘ধর্ষণ প্যান্ডেমিক’। কারণ এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকবে সরকারের প্রতি আপামর জনগণ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ – সবার ক্ষোভ।

এদের মধ্যে আবার আরেকটা দল আছে যারা সক্রিয় হয় আরেকটু পরে । এদের মাঠে দেখবেন তখনই যখন এরা টের পায় যে এত চেষ্টার পরও তাদের সব চেষ্টা-ফেষ্টাই মাঠে মারা যেতে বসেছে। এরা মূলত ‘তথাকথিত সুশীল’। সারা বছরই এরা প্রেসক্লাবের সেমিনার হলে আর টেলিভিশনের টক’শোগুলোতে অল্প-অল্প করে বহুমাত্রিক বিভ্রান্তির কিছু-কিছু ডোজ জনগণকে দিতে থাকেন আর রাস্তায় নামেন মোক্ষম সময়ে ঝোপটা বুঝে কোপটা দেওয়ার চেষ্টায়। এই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও এদের দেখেছেন। ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সিদ্ধান্তটি বাজারে আসার পরপরই এদের দেখেছেন প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে। কি সুন্দর করেই না ধর্ষকের জন্য ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বয়ান করছিলেন এইতো সেদিনই এ ঘরানার ক’জনা।

আবার পাশাপাশি আমাদের সমাজে কিছু বোকাটে ধরনের লোকও আছেন। এ বোকা লোকগুলো ওই চালাকগুলোর কাছে বারবার গোল খায়, বোকার মত এদিক-ওদিক তাকায় তারপর একসময় ঠিকই পথে নামে। কিন্তু ততদিনে দেরি একটু বেশিই হয়ে যায়। তারা এবসময় অবাক হয়ে ভাবে, তারাতো সব ঠিকঠাক মতই করলো, তবুও কেন তারাই কাঠগড়ায়। এ বোকা লোকগুলোর বেশিরভাগই আবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। আমি নিজেও একটা সময় ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলাম এবং ছিলাম এদের মতই বোকা। জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করার পর অবশেষে এতদিনে ব্যাপারগুলো একটু-আধটু বুঝি । এরাও বুঝবে যখন এরা আমার মত বয়স পঞ্চাশ ছোঁবে। বরেণ্য সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীও একটি জাতীয় দৈনিকে তার একটি সাম্প্রতিক লেখায় এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে ধর্ষণের এই রাজনীতির শেষটা কোথায়? আইনে বলা আছে ধর্ষকের জন্য বিচারক যে সাজাটি নির্ধারণ করবেন, ধর্ষকের সহযোগী, আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতারাও ঠিক সমপরিমাণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আইন করে ‘আন্দোলন চোর’ এসব চতুর লোকগুলোর বিচার করা অসম্ভব। এরজন্য প্রয়োজন সামাজিক সংষ্কৃতির যা লালন-পালনে আমাদের প্রয়াস নিরন্তর। এই কয়দিন আগেও ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর ভার্চুয়াল সম্প্রীতি সংলাপে এ নিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা দীর্ঘ আলোচনা হলো। সামাজিক সংস্কৃতির জায়গাটা এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু সন্দেহ নেই, কিন্তু এখনও এর শক্তি বিপুল। সমস্যা হচ্ছে সামাজিক সংস্কৃতিকে সময়মত সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করে যারা এগিয়ে নিবে তারা তো বারবার গোল খেয়ে যায়। একসময় খেয়েছি আমরা, আর এখন খাচ্ছে এরা!

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।



 

মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত