ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
রাঙ্গামাটির সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে ছয়জন নিহত, আহত-৭      কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের তালিকা চেয়ে হাইকোর্ট আদেশ     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মরিশাসের প্রতি আহ্বান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর        মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা: ওবায়দুল কাদের        থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা     
৯৫৮

কুকুর শাবকের লেজ সমাচার:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

মুক্তআলো২৪.কম

প্রকাশিত: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
কথায় বলে শারমেয় শাবকের দেহের পশ্চাতভাগে লেজ নামক যে অঙ্গটি থাকে তা কখনই সোজা হবার নয়। চোঙ্গাসদৃশ কোন নলাকার বস্তুর ভিতর তা যতক্ষণ থাকে তা ততক্ষণ সোজা থাকে বটে, তবে চোঙ্গা থেকে বের হলেই যেই কার সেই- পেঁচানো অঙ্গটি আবার পেঁচিয়েই যায়! হঠাৎ লেজ প্রসঙ্গটি মনে এলো অনলাইনে একটি খবর দেখে। কদিন আগেও এদেশে নিযুক্ত পাকি-রাষ্ট্রদূত মহোদয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধমক খেয়ে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন একাত্তরে এদেশে পাকিদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তার পরপরই দেখলাম রাষ্ট্রদূত মহাশয় ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য পাকিস্তানী ভিসার সমস্ত জটিলতা নাকি জলবত তরলং করে দেয়া হয়েছে। ভদ্রলোক কেন যেন ধরেই নিলেন বাংলাদেশের মানুষগুলোর পাকিস্তানী বটিকা গেলানোর এসব চাল বোঝার যোগ্যতা আমাদের এখনও হয়নি। আমরা সেই ’৪৭-এর গোবেচারা বাঙালীই রয়ে গেছি, যারা আবারও দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘোলের নেশায় মাতাল হব। এখানেই শেষ নয়, কদিন পরেই ভদ্রলোক আবার সিমলা চুক্তির কপি বগলদাবা করে হাজির সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের দফতরে। সেখানে তার অভিজ্ঞতাটা অবশ্য গণভবনের মতই। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার নিয়োগকর্তার সুরেই সুর মিলিয়েছেন। যতদূর খেয়াল পরে এতে খুব একটা শিক্ষা হয়নি ভদ্রলোকের। কদিন পরেই বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয়ের দফতরে দেখলাম তাকে। দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মধুরতর করার প্রস্তাব নিয়ে এবার হাজির তিনি। এ যাত্রায় তার অভিজ্ঞতাটা বোধকরি আগের দুবারের মতো অতটা তেতো ছিল না। এমনটা মনে করার কারণ এই সেদিনই তো গুলশানের এক গ্যালারি পরির্দশনে গিয়ে দারুণ এক খবরের জন্ম দিলেন তিনি। এ কারণেই অনলাইনে খবরটি পরে ভদ্রলোকের গোলগাল চেহারাটা মানসপটে ভেসে ওঠা মাত্রই শারমেয় শাবকের লেজের প্রসঙ্গটি মনে পড়ল।

বলিহারি বলতে হয় ভদ্রলোককে! তিনি এবার ঘোষণা দিয়েছেন, চুয়াত্তরে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের অপ্রকাশিত ছবিগুলো নিয়ে একটি এ্যালবাম প্রকাশের। তার এই প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর এই সফরটি স্বাধীন বাংলাদেশের বন্ধুর পথচলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো কখনই ভালভাবে গ্রহণ করেনি। তাদের কাছে এটি ছিল ভারতীয় হিন্দুদের প্ররোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী নামক যে ‘হাফ হিন্দু, হাফ মুসলমান’ জাতিটি বাস করে, তাদের মুসলিম পাকিস্তানকে কেটেছেঁটে দেয়ার নামান্তর মাত্র। তাছাড়া সে সময়কার বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বঙ্গীয় বদ্বীপে অমন নাকানি-চুবানি খাওয়াটাও তাদের জন্য ছিল বিব্রতকর। কারণ, ইসরাইলের সার্বক্ষণিক গরম নিশ্বাসের তলায় বসে তারা নিরাপত্তা আর স্বস্তি পেতে পূর্বদিকে পাকিস্তানের দিকেই তাকিয়ে থাকত। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের কোন মুসলিম রাষ্ট্রই বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়নি। এমন কি সৌদি আরব বাংলাদেশীদের হজ করার ধর্মীয় অধিকার পর্যন্ত কেরে নিয়েছিল। আলজিয়ার্সে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে সৌদি বাদশা প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের নাম পাল্টে পিপলস রিপাবলিক থেকে ইসলামী রিপাবলিক করা হলেই তিনি কেবল বাংলাদেশী পাসপোর্টে মক্কায় যাওয়ার অনুমতি দেবেন। বঙ্গবন্ধুও জোর জবাব দিয়েছিলেন। বাদশাহকে বিনীতভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে তার দেশের নামটিও কিন্তু ইসলামিক রিপাবলিক নয়, বরং বাদশাহর পারিবারিক টাইটেলটিকেই সৌদি আরব নামক দেশটির টাইটেল হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এহেন বৈরী পরিবেশে পাকিস্তানে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসির শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রতি আরবী বৈরিতা কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর আর সেই সফরে অনুষ্ঠিত নানা বৈঠকের ছবিগুলো নিঃসন্দেহে আমাদের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।

পাকি-রাষ্ট্রদূতের এই সর্বশেষ স্ট্যান্টবাজিটি তাই আমার কলিজা ছুয়ে গেছে। আমার আপত্তিগুলো অবশ্য অন্যখানে। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের এর চেয়েও যে ঢের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কেটেছে, যেই সময়কার ছবিগুলোও তো আমরা দেখতে চাই। একাত্তরের নয়টি মাসে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী রাখা হয়েছিল সলিটারি কনফাইনমেন্টে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামিদের যেমনটি রাখা হয় ঠিক সেভাবেই। আমি নিশ্চিত পাকিস্তানী আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে সেই সময়কার অনেক ছবিই। কেমন কেটেছিল নির্জন ছোট্ট প্রকোষ্ঠটিতে বঙ্গবন্ধুর নয়টি মাস মৃত্যুর প্রহর গুনে গুনে? আর ঐ যে কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে নিজ হাতে খোঁড়ানো হতো নিজের কবর- সেই ছবিগুলোই বা কোথায়? আমরা তো দেখতে চাই সেগুলোও। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকী সাহেব তার প্রস্তাবিত এ্যালবামটিতে সেই ছবিগুলোও সন্নিবেশিত করবেন।

আরেকটি কথা- বঙ্গবন্ধুর যেই সফরের ছবি ছাপানো নিয়ে রাষ্ট্রদূতের এত আগ্রহ, সেই সফরে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে নেয়ার জন্য যে গাড়িটি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, তাতে ছিল না বাংলাদেশের পতাকা। বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। কাজেই গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা না ঝোলানো পর্যন্ত তিনি বিমানবন্দর থেকে একচুলও নড়বেন না। কথা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষার পর গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ঝোলানোর পরই তিনি বিমানবন্দর থেকে শহরে রওনা হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাগানোর আগে আর পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ঐ গাড়িটির দুটো ছবিও জনাব সিদ্দিকী জুড়ে দিতে পারেন তার সাধের এ্যালবামটিতে।

আরও দুটো বিষয় মনে পড়ছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভুট্টোর বাগান বাড়িতে অতিথি হিসেবে। ভুট্টো আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাবে রাজি করাতে। অবশ্যই রাজি হননি বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর সেই প্রস্তাবে। বরং বঙ্গবন্ধুকে তুষ্ট করার চেষ্টায় ভুট্টো যখন জানতে চেয়েছিলেন তিনি তার কোন ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন কিনা, তখন বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতটি শুনতে চান। বাধ্য হয়ে ‘আমার সোনার বাংলা ... ...’ বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন জনাব ভুট্টো। ভুট্টোর বাগান বাড়িতে বাজছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, দাঁড়িয়ে আছেন গর্বিত বঙ্গবন্ধু আর পাশে দাঁড়িয়ে ভুট্টো, মুখটা কালো, মাথাটা নিচু- আহা, সেই ছবিটা যদি একবার দেখতে পেতাম! সিদ্দিকী সাহেব যদি আমার এই আশাটি পূরণ করতেন! চুয়াত্তরে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভুট্টো সাহেব। তাকে দেখতে রাস্তায় ছিল ‘বাংলাস্তানীদের’ উপচে পড়া ভিড়। বাংলাদেশের ঐসব পিতৃপরিচয়হীন নাগরিকদের আজকের প্রজন্মকে আমরা ভালই চিনি। এরা কখনও ‘মেরি মি আফ্রিদি’ ব্যানারে স্টেডিয়ামের গ্যালারির শোভা বাড়ায়, তো কখনও ‘আমি রাজাকার’ লেখা টিশার্ট পরে তোলা সেলফিতে ফেসবুক সয়লাব করে। এরাই তারা যাদের কাছে কোভিশিল্ড ‘মুরগির ভ্যাকসিন’ কিংবা ‘বোতলে ভরা বুড়িগঙ্গার পানি’। সমস্যা হচ্ছে সেদিনের ঐ রাস্তায় ভিড় জমানো বাংলাস্তানীদের আমরা ঠিকঠাক মতো চিনি না, অথচ চেনাটা জরুরী। খুবই জরুরী। সিদ্দিকী সাহেবের কাছে আরেকটা অনুরোধ থাকবে, ভুট্টোর ঢাকা সফরের সময়কার ঢাকার রাজপথে ভিড় করা ঐ অমানুষগুলোর ছবিগুলো ক্লোজ শর্টে তার এ্যালবামটিতে ছাপানোর জন্য।

সিদ্দিকী সাহেব খুব স্মার্ট। নিত্য নতুন চমকে তিনি চমককৃত করছেন আমাদের, কখনও মাফ চাওয়ার কেচ্ছা শুনিয়ে তো কখনও এ্যালবামের গপ্প দিয়ে। আমি তার এই স্মার্টনেসটা পছন্দই করি। আবার তার জন্য আমার একটু করুণাও হয়। বেচারা কেন যে আমাদের এতটা বেকুব ভাবেন কে জানে? আমরা তো সেই ছোট বেলা থেকেই শিখে এসেছি শারমেয় শাবকের লেজটা বক্রাকৃতির আর শারমেয়র গর্ভ থেকে শারমেয় ভিন্ন অন্য কোন কিছুর জন্ম হয় না!


লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত