ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
আগামী ২৮ এপ্রিল খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্ধ থাকবে অ্যাসেম্বলি     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি        বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের        বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর     
১৩৮৮

করোনাকালে ‘কিটতত্ত্বকে’ ছাপিয়ে গোটা দেশ এখন বিভোর ‘কিটতত্ত্বে

লেখক : ১. ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান ২. অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ৫ মে ২০২০  

লেখক :  ১. ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান ২. অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল

লেখক : ১. ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান ২. অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল


ভাইরোলজির বাংলা নিশ্চয়ই কিটতত্ত্ব নয়। কিন্তু অনেক খুঁজেও এর চেয়ে ভালো বাংলা আর মাথায় আসলো না। যা হোক এ করোনাকালে ‘কিটতত্ত্বকে’ ছাপিয়ে গোটা দেশ এখন বিভোর ‘কিটতত্ত্বে’। এ নিয়ে বলাবলি আর লেখালেখির যে গড্ডালিকা প্রবাহ এখন শতত প্রবাহমান, তা দেখে একটু কলম না ধরে পারা গেলো না। কারণ জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে, বলে-লিখে চলেছেন অনেকেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ছে বিভ্রান্তির ব্যারোমিটার আর চড়ছে প্রত্যাশার পারদ। সেই প্রত্যাশার রাশ টেনে ধরা আর যারা না বুঝে বিভ্রান্ত তাদের বোঝায় একটু সাহায্য করার তাগিদ থেকেই এই কলম ধরা। সম্প্রতি যে কিটটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, জানা যাচ্ছে এখানে কিট আসলে দুটি। এর মধ্যে একটি এন্টিজেন কিট। মনে রাখতে হবে এন্টিজেন কিট তৈরি করতে হলে প্রথমেই এন্টিজেনটিকে শনাক্ত করে তারপর সিকোয়েন্সিং করতে হয়। উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন ট্রাস্টি নিজেই মিডিয়ায় বলেছেন তাদের প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সিকোয়েন্সার নেই। কাজেই তারা এমনটি করতে পেরেছে এটি বিশ্বাস করা একটু কষ্টকর। আর তারা যদি এটি করেই থাকেন তবে তাদের উচিত হবে প্রথমেই এটি পেটেন্ট করা। নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য না হলেও দেশের স্বার্থেই তা করা উচিত। নয়তো বিদেশি যে কেউ যেকোনো সময় এটি পেটেন্ট করে নিতে পারে। যে কারণে রেডিও আবিষ্কারের কৃতিত্ব ইতালির মার্কনির, আমাদের জগদীশ চন্দ্র বোসের নয় এবং এই একই কারণে ইলিশ মাছের পেটেন্ট আমাদের হলেও রসগোল্লার পেটেন্ট ভারতের। তারপরও যদি তারা পেটেন্ট করতে নাই-ই চান, তবে তাদের কী উচিত নয় এই মুহূর্তে তাদের আবিষ্কৃত এন্টিজেনটির এমাইনো এসিড সিকোয়েন্সটি প্রকাশ করা। কারণ সেক্ষেত্রে তো শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং পৃথিবীর তাবৎ দেশেই এই কিট উৎপাদন আরম্ভ হতো। উপকার হতো বিশ্ব মানবতার। তার চেয়েও বড় কথা তাহলে তো খুব দ্রুতই ঝঅজঝ-ঈড়ঠ-২-এর শতভাগ কার্যকর ভ্যাকসিনও তৈরি করা যেতো। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রথমে দাবি করেছিলো যে তারা তাদের ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের জন্য বিদেশ থেকে এন্টিজেন আমদানি করেছিলেন। তাদের ভাষ্যমতে, এই এন্টিজেনটি যদি তাদের আবিষ্কৃতই হয়ে থাকে, তাহলে এটি কীভাবে বিদেশে বিক্রি হচ্ছিলো? তাছাড়া গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র তাদের উদ্ভাবিত কিটটির অনুমোদনের জন্য কেন যেন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতে চাচ্ছেন না। ন্যাসভ্যাক নামক হেপাটাইটিস বি’র নতুন ওষুধটি উদ্ভাবন ও বাংলাদেশে আইন মেনে সফলভাবে এর ফেজ-১, ২ এবং ৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দুজন খুব ভালোমত জানি যে, এদেশে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হলে প্রথম ধাপে উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রকে আইন অনুযায়ী একটি ঈড়হঃৎধপঃ জবংবধৎপয ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ঈজঙ) নিয়োগ প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ পর্যন্ত সর্বমোট ৮টি প্রতিষ্ঠানকে ঈজঙ হিসাবে কাজ করার অনুমোদন প্রদান করেছেন। দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর আগে ঈজঙ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রটোকল প্রস্তুত করে তা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (ইগজঈ)-এর ন্যাশনাল রিসার্চ এথিক্স কমিটিতে (ঘজঊঈ) জমা দেবে। তৃতীয় ধাপে ঘজঊঈ-এর অনুমোদনের পর সেখান থেকে অনুমোদিত প্রটোকলটি যাবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যাডভাইজরি কমিটিতে। চতুর্থ ধাপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যাডভাইজরি কমিটির অনুমোদনের পর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি আরম্ভ করা যাবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি সম্পন্ন হলেই কেবল ঈজঙ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। পঞ্চম ধাপে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর তাদের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটিতে পাঠাবে।
ওষুধ ও ডিভাইস ‘উদ্ভাবন থেকে রেজিস্ট্রেশন’ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি সারা পৃথিবীতেই একই রকম। কোনো দেশেই সরকার বা ওষুধ প্রশাসন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করতে পারেন না। আমেরিকার ওষুধ প্রশাসন ইংরেজিতে টঝ ঋউঅ ইতিহাসে কোনোদিনও কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করেছে এমন উদাহরণ নেই। সারা পৃথিবীতেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান ঈজঙ-এর মাধ্যমে করে থাকেন। কোভিড-১৯-এর মতো জরুরি পরিস্থিতিতে সরকার এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করায় সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু কোনোভাবেই উপরের ৫টি ধাপের একটিও বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটিই আন্তর্জাতিক কনভেনশন। তাছাড়া তড়িঘরি করে কিট বাজারে নিয়ে আসলে তা বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে তড়িঘরি করে অনুমোদন নিয়ে কিট ব্যবহার করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেনের মতো দেশগুলো আজ এতো বড় বিপর্যয়ে পড়েছে। কারণ এই র‌্যাপিড কিটগুলোর ফলস পজিটিভ ও ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়ার হার খুবই বেশি। ফলে রোগ নির্ণয়ে এই কিটগুলো ব্যবহার করলে অনেক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি রোগ নিয়ে চলাফেরা করে এটি সমাজে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এ কারণেই সব নিয়মনীতি মেনে নিজ দেশে ডেভেলপ করা কিট বাজারে ছাড়ার ৭ দিনের মধ্যে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ তা বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং স্পেন ও চেক রিপাবলিকও আমদানিকৃত মিলিয়ন ডলারের কিট চায়নায় ফেরত পাঠিয়েছে। গণস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত নিজে বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে সে সব কাঁচামাল বিমানে তুলে দিয়েছেন। পল্লী বিদ্যুৎ গণস্বাস্থ্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন। এসব কথা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ট্রাস্টির জবানীতেই জানতে পেরেছি।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র তাদের কিটটি প্রিন্টেড মোড়কে উপস্থাপন করেছে। তাছাড়া তারা কিটের দামও বারবার বলছে। আমাদের ওষুধ নীতি অনুযায়ী এই দুটিই আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ ওষুধ বা কিটের মোড়ক এবং দাম এ দুটি ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া বাধ্যতামূলক। পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। আর ১০ জনের মতো আমরাও খুঁজছি মুক্তির কোনো একটা উপায়। আমরাও মুখিয়ে আছি এমন একটি টেস্টের জন্য যা দিয়ে রোগটি সত্যি সত্যি ১৫ মিনিটে শনাক্ত করা যাবে। আর তা যদি হয় ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু এমন দুঃসময়ে কোনো অলীক সোনার হরিণের পেছনে ছোটার সময় বা সুযোগ কোনোটাই আমাদের নেই। ডুবন্ত মানুষ তো খড়কুটো আঁকড়ে ধরবেই। কিন্তু খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচেছে কে, কবে? আর ডুবন্ত মানুষের সামনে খড়কুটো এগিয়ে দেওয়াটা কি অন্যায় আর অমানবিক নয়?

লেখক : 
১. ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
২. অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত