ঢাকা, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ || ৪ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  খালেদার নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ সভায় ১৭ এপ্রিল পালনের প্রয়োজন নেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল        ঝালকাঠিতে ট্রাক, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত        মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রতি নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর        ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন প্রধানমন্ত্রীর     
১৩৪৬

করোনা কাল’ থেকে ‘বাসন্তী কাল’:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২০  

অধ্যাপক  ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
ক’দিন আগে ডিবিসি চ্যানেলে একটা টক’শোতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের নামটা মনে গেঁথে গিয়েছিল – ‘করোনা কালের চিকিৎসা পত্র’। ‘করোনা কাল’ খুবই শক্তিশালী একটা শব্দ। আমার ধারণা ভবিষ্যতের বাংলাদেশে লেখালেখি আর টক’শোতে যখন আজকের সময়টা নিয়ে আলোচনা আর ব্যবচ্ছেদ চলবে তখন এই সময়টাকে হয়তো ‘করোনা কাল’ নামেই চিহ্নিত করা হবে বলে। এই করোনাভাইরাস কালে আমাদের ভোগান্তি আর দুর্ভোগের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। এই করোনা কালে ভাল থাকতে কি করতে হবে আর কোনটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে এ নিয়ে বলা আর লেখা হয়েছে বিস্তর। হচ্ছে এখনো। হবে আরো বেশ কিছুদিন। করোনা কালের প্রাপ্তি হচ্ছে আমরা বেশকিছু নতুন লেখক পাচ্ছি, পাচ্ছি টক’শোগুলোতে নতুন নতুন মুখও। করোনা কালের নানা মাত্রার সাথে তারা যোগ করছেন আরো নতুন সব মাত্রা। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় করোনাভাইরাস আমাদের সামনে টাইম মেশিনে চড়ে টাইম ট্রাভেলের একটা অদ্ভুত সুযোগ এনে দিয়েছে। জাপানের নারা শহরটি ওখানকার পার্কে চড়ে বেড়ানো শ’য়ে-শ’য়ে হরিণের জন্য বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ঐ নারা শহরের বাসিন্দারা কে কবে তাদের শহরের রাস্তায়-রাস্তায় হরিণ ঘুরে বেড়াতে দেখেছে কে জানে! আমি তো অন্ততঃ বলতে পারি, আমি তো আমি, আমার পূর্বপুরুষরা এই নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে থাকলে আজ স্বাক্ষ্য দিতেন যে তারা কেউ কোনদিনও কক্সবাজার শহরের লাগোয়া সমুদ্রে ডলফিনের জলকেলি দেখেননি। আর এটা তো নিশ্চিত যে আজকের পৃথিবীর কেউই পাঁচ’শ বছর আগে পৃথিবীর পরিবেশটা কেমন ছিল তা দেখেনি। বলা হচ্ছে জীবাশ্ব জ্বালানীর ব্যবহার তলানিতে এসে ঠেকায় পৃথিবীর পরিবেশ ফিরে যাবে পাঁচ’শ বছর আগের পৃথিবীতে আর এমনকি থেমে যেতে পারে দুই মেরুতে হিমবাহগুলোর গলতে থাকাও।

আর শুধু অতদুরের পৃথিবী কেন, করোনাভাইরাস সম্ভবত আমাদের কাছাকাছি সময়ের অতীতটাও দেখার এবং বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে। পঁচাত্তরে আমাদের প্রজন্মের যারা তাদের বয়স ছিল পাঁচ থেকে সাত বছর। সে সময়কার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের প্রজন্ম আর আমাদের পরের প্রজন্মের মানুষগুলো জেনেছে পড়ে, শুনে আর তারপর বুঝে। সেসব কাছ থেকে দেখা আছে আমার আগের প্রজন্মের, কিন্তু আমাদের না। আমরা চুয়াত্তরের মন্বন্তর আর পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটকে জেনেছি এভাবেই।

বাসন্তীকেও চিনেছি একইভাবে। জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় বাসন্তীর জালে জড়ানো ছবি সে সময়টায় আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজের উপর ছিল বড় ধরণের আঘাত। অনেক পরে আমরা জেনেছিলাম মাত্র পঞ্চাশটি টাকার বিনিময়ে বাসন্তী ঐ ছবিতে মডেল হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের পুকুর চুরিতে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ আর বাসন্তীর শরীরে জাল – এই ছিল পঁচাত্তরের ন্যারেটিভ। কেউ একটিবারের জন্যও বলেননি যে, পিএল-৪৮০-এর চাল বোঝাই জাহাজ মার্কিনিরা মাঝ সমুদ্র থেকে ফিরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশে দেখা দিয়েছিল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য নয়। কেউ একটিবারের জন্যও প্রশ্ন করেননি কেন বাসন্তীর গায়ে শাড়ির বদলে জাল, শাড়ির চেয়ে জালের দাম এখনকার মত তখনও অনেক বেশি ছিল। পঁচাত্তরে বাংলাদেশে বাম্পার ফলন হয়েছিল যার সুফল ঘরে তুলেছিল অবৈধভাবে গদিতে বসা জেনারেল জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ১৯৭৬-এ। অথচ এই ফলনের কথা পঁচাত্তরে কেউ বলেননি। কারণ পঁচাত্তরে ১৫ অগাস্ট ঘটানো না গেলে ‘৭৬-এ তা হতো অসম্ভব।

করোনাভাইরাসের এই কালে অনেকগুলো হিসেব সহসা কেন যেন মিলছে না। এই যেমন বঙ্গবন্ধু’র খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদ কেন হঠাৎ ঢাকায়? এমন তো না যে করোনাভাইরাস কোলকাতায় আছে কিন্তু ঢাকায় নেই। হঠাৎ কেন আওয়ামী লীগ নেতাদের আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চাল আর গম চুরির গল্পে সয়লাব মিডিয়া? আমি অনেক ঘেটে বের করেছি ১৪ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ১২ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ত্রাণ লোপাটের দায়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এর সাথে আরামে যোগ দিতে পারেন আরো জনা দশেক আওয়ামী লীগ নেতার নাম। এই লেখার বাকি অংশটুকু পড়ার আগে একটি ক্যালকুলেটর নিয়ে বসুন।

কারো কি জানা আছে এদেশে মোট নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কয়জন? হিসাবটি জেনে নিন। বাংলাদেশে নির্বাচিত এম.পি. আছেন ৩৫০ জন, নির্বাচিত পৌর মেয়র ৩৩০ জন, নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯২ জন, নির্বাচিত পুরুষ ও মহিলা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ৯৮৪ জন, নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৪৫৭১ জন এবং নির্বাচিত পুরুষ ও মহিলা ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ৫৪৮৫২ জন অর্থাৎ ৬১৫৭৯ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর এর যত স্বীকৃত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এদের সবগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে ইউনিয়ন আর ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটিগুলো পর্যন্ত বিবেচনায় আনলে মোট পদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতাই এদেশে আছেন ৫০ লক্ষাধিক। তাহলে এখন বলুন এদেশে দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ নেতা আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পার্সেন্টেজ ক্যালকুলেটর ছাড়া হিসেব করা সম্ভব কিনা।

জানি অবিশ্বাসীরা যুক্তি দেখাবেন, ‘দুর্নীতিবাজের প্রকৃত সংখ্যা আসলে অনেক বেশি, সরকার মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরায় বের হচ্ছে না আসল সংখ্যাটা’। অথচ কেউ একবারের জন্যও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী আর ডিলারদের হিসাবে আনবেন না। ভুলে গেলে চলবে না যে দেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যা ২৫-এর বেশি। সাথে আছে শতাধিক প্রিন্ট মিডিয়া আর ৫ কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী। কাজেই এদেশে আর যা কিছুই সম্ভব হোক না কেন মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরাটা এত সহজ না।

করোনা কালের না মেলা হিসেবগুলো মাঝেমধ্যে যে একটু উদ্বিগ্ন করে না, তা কিন্তু না। তারপর আবার আশ্বস্ত হই। মনে পড়ে আজকের এই অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মানুষ এখন সহজেই সত্যিটা জেনে নিতে পারে। মিলিয়ে দেখতে পারে নিজের প্রেক্ষাপটের সাথে প্রতিবেশী আর উন্নত দেশগুলোর বাস্তবতাও। কাজেই মানুষকে বোকা বানানো এখন অসম্ভব, এমনকি এই করোনা কালেও।

ভাল কথা, বাসন্তীর কথা জানেন কি? ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বাসন্তীর খোঁজ রাখেনি কেউ-ই, যদিও তার জাল জড়ানো ছবি দিয়ে আখের গুছিয়েছে অনেকেই। বাসন্তীকে প্রথম ঘরটা বানিয়ে দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে। বাসন্তীর দ্বিতীয় ঘরটিও শেখ হাসিনারই করে দেয়া যখন তিনি ২০০৯-এর পর দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতায়। বাসন্তী এখন থাকেন তার তৃতীয় ঘরটিতে তার ভাইয়ের সাথে, কারণ তার প্রথম দু’টি ঘরই নদী ভাঙ্গনে ভেঙ্গে গেছে। বাসন্তী সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পান।


লেখক : অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) 
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত