ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ || ১২ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
আগামী ২৮ এপ্রিল খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্ধ থাকবে অ্যাসেম্বলি     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি        বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের        বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর     
১২০৯

ওগো তোরা আজ যাসরে ঘরের বাহিরে!:অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২ জুলাই ২০২০  

অধ্যাপক  ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) :
‘একটি শোকগাথা’ নামে প্রবন্ধটি লিখেছেন অগ্রজপ্রতিম রেজা সেলিম ভাই তার অনুজপ্রতিম, সদ্যপ্রয়াত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব আব্দুল্লাহ আল মহসিন চৌধুরীর স্মরণে। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত লেখাটির ছত্রে-ছত্রে প্রিয়জন হারানোর বেদনা।

দু’দিন আগে কথা হচ্ছিল কামরান চাচীর সাথে। মিসেস বদরুদ্দিন কামরান, সদ্য প্রয়াত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়রের অকাল বিধবা স্ত্রী। ফোন করেছিলেন আমার খবরা-খবর নিতে। সপরিবারে কোভিড-১৯ কাটিয়ে ওঠায় অভিনন্দন জানাতে। চাচীর অঝোরে কান্নায় কথা না ফুরাতেই একসময় সংযোগটা বিচ্ছিন্ন হলো।

আমার কোভিড ডায়াগনোসিস হয় জুনের ১৩ তারিখে। নুজহাত আর সুর্য’র রিপোর্ট পজেটিভ আসে তার একদিন পর। আমার কোভিড ধরা পড়ার আগের দিন দুপুরে বসেছিলাম মোহাম্মদপুরে আল মারকাজুল ইসলামীর পরিচালকের অফিসে। পাশে সদ্য পিতা হারানোর শোকে ভারাক্রান্ত সাবেক সাংসদ প্রকৌশলী জয়। তখনো গোসল শেষ হয়নি তার প্রয়াত পিতা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম এমপি’র।

আমি নিজে যখন কোভিডে হোম আইসোলেশনে তখন আমাকে স্বান্তনা দিতে ফোন করেছিল আনন্দ জামান। ক’দিনই বা হলো বেচারা হারিয়েছে তার পিতাকে আর আমরা হারিয়েছি আমাদের জাতীয় সম্পদ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারকে। কোথায় আমি স্বান্তনা দেব, তা না, উল্টো আনন্দই আমাকে সাহস যোগাচ্ছে।

মনে পড়ছে মান্নান ভাইয়ের কথাও। তাকে ফোন করে সাহস দেয়ার শক্তি এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। সদ্য নিযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা সচিব মান্নান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় প্রায় দু’যুগের, যখন তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব আর আমি মেডিকেল অফিসার। সেই সুবাদে ভাবীর সাথেও পরিচয়টা প্রায় দু’যুগেরই। সেই ভাবীও আজ শুধুই স্মৃতি।

কোভিডে আমরা যাদের হারিয়েছি দীর্ঘ সেই তালিকায় আছেন সদ্যপ্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কামাল লোহানী, মাননীয় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক-এর স্ত্রী মিসেস লায়লা আরজুমান্দ বানু, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আলহাজ্জ মকবুল হোসেনসহ এমনি আরো অনেকের নাম যারা অংশ নিয়েছিলেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কিংবা সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে অথবা সংশ্লিষ্ট আছেন প্রশাসনযন্ত্রের নানা পর্যায়ে। মৃত্যুবরণ করেছেন কমপক্ষে ষাট জন চিকিৎসক, সকল বয়সের এবং পদের। এই তালিকায় যেমন আছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রতিথযশা অধ্যাপক, তেমনি আছেন সদ্য পাশ করা মেডিকেল অফিসারও। মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় সমসংখ্যক পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে আছেন কনস্টেবল থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও। এর বাইরে এমন আরো হাজার জন আছেন যারা আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু স্রষ্টার অপার কৃপায় আমাদের মত সুস্থতা অর্জন করেছেন। আর অনেকে এখনো হোম আইসোলেশন বা হাসপাতালের বেডে শুয়ে পেন্ডুলামের দোলায় দুলছেন। এরা প্রত্যেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন কারণ তারা এই সময়টায় ঘরের চার দেয়ালে নিজেদের সুরক্ষিত না রেখে বরং নিজ-নিজ জায়গা থেকে মানুষের কল্যাণে ব্রতী থাকাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন।

আমরা যখন অসুস্থ ছিলাম তখন বাংলাদেশটাকে নতুন ভাবে চিনেছি। অবাক হয়ে দেখেছি কত হাজার অচেনা জন আমাদের সুস্থতা কামনায় নিজ-নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে প্রার্থনা করছেন আর শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা ফোনে। অবাক হয়ে দেখেছি আমাদের জন্য দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে যেমন পাকুন্দিয়ার এতিমখানায় কিংবা কাকরাইলে তবলিগ জামাতের মসজিদে, তেমনি দোয়া হয়েছে আজমীর শরীফে হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) আর পুরাতন দিল্লীতে হযরত সৈয়দ নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহঃ)-এর দরগায়ও। দুরুদ শরীফের খতম হয়েছে ফেনীতে আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের উদ্যোগে বাদ জুম্মা মোনাজাত হয়েছে ময়মনসিংহে।

অনুজপ্রতিম প্রতীকের মা কিংবা বন্ধুবর দিব্যেন্দু যখন পুজা চড়িয়েছেন ঠাকুরের চরণে তখন স্বপন মামা কোলকাতায় বসে রথ যাত্রার দিন আমাদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন ভগবান জগন্নাথদেবের কাছে। প্রার্থনা হয়েছে চট্রগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার, ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহার আর এমনকি ভারতের বুদ্ধ গয়ায় ভগবান বুদ্ধের বধিবৃক্ষের পদতলেও। এসব যতই দেখেছি অবাক হয়ে ভেবেছি কি অদ্ভুত সুন্দর এই দেশটা আর কি অদ্ভুত সুন্দর এদেশের মানুষগুলো আর তাদের চেতনার কতই না গভীরে কি অদ্ভুতভাবে প্রতিথ অসাম্প্রদায়িকতার শিকড়।

আবার এও সত্যি পাশাপাশি এর উল্টো কদর্য বাংলাদেশটাকেও একটু-আধটু দেখতে পেয়েছি। আমাদের অসুস্থতার সময় আইসোলেশনের নিরবিচ্ছিন্ন অবসরে ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে চোখে পড়েছে কোটা সংষ্কারবাদীদের একটি পোস্ট। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার দুই সহকর্মী, সহধর্মীনি ডা. নুজহাত চৌধুরী এবং অগ্রজপ্রতিম অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার কোভিড আক্রান্তের খবর সেখানে শেয়ার করা আর তাতে ‘হা!হা!’ পোস্টও দিয়েছে এ প্রজন্মের অনেকেই। স্ক্রিনশটটা স্বযত্নে রেখে দিয়েছি যাতে ভুলে না যাই এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি!

মুক্তিযোদ্ধা, সংষ্কৃতিজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ফেসবুক স্ট্যাটাসেও ঘৃণা। এমনকি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কোভিড আক্রান্ত হওয়াটাও ছিল অনেকের নারকীয় উল্লাসের বিষয়বস্তু। আর জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম এমপি’র মৃত্যুতে উল্লসিতদের কলঙ্কিত তালিকায় যুক্ত হয়েছে এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নামও।

আর ক’দিন আগে বিদ্যানন্দের প্রধান নির্বাহী কিশোরের তো আরেকটু হলে সব ছেড়েছুড়ে ঘরে গিয়ে বসে থাকার উপক্রম হয়েছিল প্রায়। বেচারার দোষ পথশিশুদের কাছে এক টাকায় আহার পৌঁছে দেয়া আর সরকারের পাশে দাঁড়ানো কোভিড-১৯ মোকাবেলায়।

এই লোকগুলো ট্রলের শিকার হন, হেনস্তা হন ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, কখনো-কখনো বিপদগ্রস্ত হন ধুলামাটির ধরাতেও আর এমনকি মৃত্যুর পরও স্বস্তি পান না। তাদের অপরাধ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, তাদের কারো কারো বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তো কারো ভোট পড়ে বঙ্গবন্ধুর মার্কা নৌকায় অথবা তারা রবীন্দ্রসংগীত গান কিংবা মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের পাশে দাড়ান।

আল মারকাজুল ইসলামীর পরিচালকের দপ্তরে বসে প্রকৌশলী জয় প্রশ্ন করছিলেন কেন এমন অকালে বিদায় নিতে হলো তার পিতাকে। কিছু কিছু পোস্ট বলছে মোহাম্মদ নাসিমরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন কারণ তারা বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রকৌশলী জয়কে আমিও একই কথাই বলেছি। তার বাবা, আমরা, আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করেছি বলেই, ঘরে বসে থাকিনি। একাত্তরে যেমন বসে থাকেনি তার প্রয়াত পিতা বা পিতামহরা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যারা বিশ্বাস করেন, এমন সময় তারা ঘরে বসে থাকতে পারেন না!


লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) 
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।


মুক্তআলো২৪.কম

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত