ঢাকা, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ || ১০ বৈশাখ ১৪৩১
Breaking:
ঢাকায় ভিসা সেন্টার চালু করেছে চীনা দূতাবাস     
Mukto Alo24 :: মুক্ত আলোর পথে সত্যের সন্ধানে
সর্বশেষ:
  বিরাজমান তাবদাহ অব্যাহত থাকতে পারে        স্থিতিশীল সরকার থাকায় দেশে উন্নয়ন হয়েছে : ওবায়দুল কাদের        বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির        বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই     
১২৫২

আটাশে নির্মূল কমিটি : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মুক্তআলো২৪.কম

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২০  

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):মুজিববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সেদিন দেখা হতেই সহাস্যে বললেন, ‘আপনার জন্য সুখবর আছে। মুজিববর্ষে সরকার বঙ্গবন্ধু পদক প্রবর্তন করতে যাচ্ছে’। আমাকে বলার কারণ গত বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আমার লেখা একটি প্রবন্ধে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছিলাম। লেখাটি দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল। তবে এ কথাও সত্যি যে এটি আমার মৌলিক চিন্তাপ্রসূত নয়। গত বছরই মুজিববর্ষ উদযাপন নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রথম উপস্থাপন করেছিলেন সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

নির্মূল কমিটির সঙ্গে আমার সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা তিন বছরের। সংগঠনটির সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে আমাকে এর কেন্দ্রীয় কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় পদে নির্বাচিত করা হয়। তবে সংগঠনটির সঙ্গে আমার চেনাজানা বহু বছরের, বলতে গেলে বৈবাহিক সূত্রে। ৯৬’এ বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি আমার শাশুড়ি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী কী প্রচণ্ড আবেক নিয়ে এই সংগঠনটি করে আসছেন। আমার স্ত্রী ডা. নুজহাত চৌধুরীও প্রজন্ম একাত্তরের পাশাপাশি নির্মূল কমিটিতে সক্রিয় দীর্ঘদিন ধরে। দুজনই এখন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। কাজেই সংগঠনটিকে খুব কাছ থেকে দেখার-চেনার বিস্তর সুযোগ আমার হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সেই কবে থেকে সোচ্চার নির্মূল কমিটি। আশির দশকের শেষের দিকে আর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তথাকথিত গণতান্ত্রিক বিএনপি সরকারের শাসনামলে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির আন্দোলন আর গণআদালত ছিল আমাদের জন্য আশা জাগানিয়া। এরশাদের শাসনের শেষের দিকে আরও অনেকের মতোই ছাত্রলীগের সুবাদে আমার প্রগতিশীল রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বঙ্গবন্ধু আর একাত্তরকে চেনার-বোঝার সেই থেকে শুরু। সেটা ছিল জয় বাংলার নিষিদ্ধকাল। জয় বাংলা স্লোগান দেয়ার অপরাধে কতবার যে ছাত্রদলের ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছি, লাঞ্ছিত হয়েছেন যে আরও কত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী তার ইয়ত্তা নেই। বিএনপির শাসনামালে বয়েজ হোস্টেল থেকে বহিষ্কৃৃত আমাদের ঠিকানা ছিল ময়মনসিংহ শহরের ভাড়াকরা কিছু বাসা। সম্ভবত ১৯৯৩ সালের কথা। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ক্যাম্পাসে ৭ মার্চের ভাষণ বাজানোর অপরাধে আমাদের ভাড়াবাসায় পর্যন্ত হামলা চালিয়েছিল ছাত্রদলের ক্যাডার বাহিনী। বাংলাদেশে সেই কঠিন সময়টাতে আমরা ছাত্রলীগ নামক সংগঠনটিকে আকড়ে ধরেছিলাম আমাদের অস্তিত্বের ভেতর থেকে। একবারের জন্য স্বপ্নেও ভাবিনি যে আজকের দিনটি আসবে যেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে আওয়ামী লীগ। সে সময়টায় আমরা স্লোগান দিতাম, ‘সাইদী-নিজামী ভাই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’। স্লোগান দিতাম এই বিশ্বাস থেকে যে লাখো শহীদের রক্তে সিক্ত এই বাংলায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হতেই হবে। জানতাম না কবে-কীভাবে? আর এই বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখায়, আমাদের এই চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখায়, শহীদজননী জাহানারা ইমাম আর তার হাতেগড়া নির্মূল কমিটি আমাদের অসম্ভব শক্তি যুগিয়েছে, আশা জাগিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রশিতে ঝুলেছে একের পর এক যুদ্ধাপরাধী। প্রধানমন্ত্রী আরও অসংখ্য কারণের পাশাপাশি এ কারণেও নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লিখিয়েছেন নিঃসন্দেহে। তবে তার জন্য এই দুর্গম পথচলাকে সুগম করায় আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দাবিতে জনমত সংগঠিত করা ও ধরে রাখায় আর একের পর এক নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বিজয় ছিনিয়ে আনায় নির্মূল কমিটির অবদান প্রণিধানযোগ্য।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অনেককেই বলতে শুনেছি এখন আর নির্মূল কমিটির কী দরকার? আর কী-ই বা প্রয়োজন আন্দোলনটিকে জিইয়ে রাখার? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিমনা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নির্মূল কমিটির প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি তার ছোট্ট একটি উদাহরণ এই লেখার শুরুতেই দিয়েছি। এমনি উদাহরণ আছে আরও ভুড়ি-ভুড়ি। নির্মূল কমিটির কাছে প্রত্যাশাও তাই অশেষ।


ডাক্তারি করার সুবিধাটা হচ্ছে এই যে প্রতিদিন চেম্বারে নানা পেশার অনেক মানুষকে চেনার-জানার সুযোগ হয়। আমি প্রাত্যহিকই এই সুযোগটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি আমাদের সমাজটাকে আরেকটু ভালো করে বোঝার জন্য। আমাদের এই অঞ্চলে একদিন ইসলামের প্রচার হয়েছিল সুফি-সাধক আর আউলিয়াদের মাধ্যমে। শাসকের তরবারি এ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেনি। এটি-ই আমাদের এ অঞ্চলে বিরাজমান ধর্মীয় সম্প্রীতি আর আন্তঃধর্ম সহাবস্থানের মূল কারণ। তারপরও ইদানীং অবাক হয়ে দেখি এদেশেও মৌলবাদ মাঝে-সাঝেই মাথাচাড়া দেয়ার দুঃসাহস দেখায়। এ ব্যাপারে আমার একটা ব্যাখ্যা আছে। আমাদের যে প্রবাসী জনগোষ্ঠী উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন তাদের একটা বড় অংশের বসবাস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এদের বেশিরভাগই খুব অল্প বয়সে পরিবার-পরিজন পেছনে ফেলে জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে দের-দু’যুগ কাটিয়ে তারা যখন দেশে ফেরেন তখন এলাকায় অর্থ-বিত্ত-বৈভবে তারাই প্রভাবশালী। সমাজে তাদের জন্য তৈরি হয় আলাদা একটা জায়গা। লক্ষ্যণীয় সবাই না হলেও, এদের অনেকে দেশে ফেরেন মধ্যপ্রাচ্যের ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত হয়ে। নতুন আমদানি করা ওয়াহাবিবাদ আর এদেশে যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত সুফিবাদ যখন সরাসরি সাংঘর্ষিক, তখন সমাজে এর ফলে যে দ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন শুরু হয় সেই বিভ্রান্তির সুযোগে সমাজে ঢুকে পড়ে মৌলবাদ।


আমার লেখাপড়ার একটা অংশ লন্ডনে। বিলেতে থাকার সময় আমি প্রায় দুই বছর কাজ করেছি হোয়াইট চ্যাপেলের রয়েল লন্ডন হাসপাতালে। হাসপাতালটা লন্ডনের বাংলা টাউনের ঠিক বিপরীতে। ’৯৯-এ লন্ডন থেকে পাকাপাকিভাবে দেশে ফেরার পর লন্ডনে যাওয়া পড়েছে বেশ ক’বারই, কিন্তু কেন যেন যাওয়া হয়ে ওঠেনি স্মৃতিবিজড়িত ইস্ট লন্ডনে। গেলাম আবার ২০১৫-তে। সেবারে আমার লন্ডন যাওয়া নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় ও ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আর সিভিল সোসাইটির কাছে বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্বচ্ছতা আর যৌক্তিকতা তুলে ধরা। পাশাপাশি সে দেশে বসবাসরত বাঙালি বংশোদ্ভূতদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে পরিচিত করে তোলাও। অবাক হয়ে সেবার দেখেছি ব্রিকলেনে ‘আলবদর রেস্টুরেন্ট’। এই সেদিনও লন্ডন ঘুরে এসে একজন সহকর্মী জানালেন রেস্টুরেন্টটি এখনও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। ইস্ট লন্ডন মস্কের প্রভাবে আর মসজিদে মসজিদে পাকিস্তানি, আফগান আর ইরানি ইমামদের কাছ থেকে ইউকে প্রবাসী বাঙালিদের অনেকেরই প্রথমবারের মতো ইসলামের সাথে পরিচয়। তাদের অনেকের হৃদয়েই তাই রক্তক্ষরণ হয় সিরীয় শরণার্থীদের দুর্দশায় আর তাদের জাকাত চলে যায় গাজায় কিংবা সানায়। এতে দোষের কিছুই নেই। শুধু খারাপ লাগে যখন দেখি বাংলাদেশ আর বাঙালির ভালো-মন্দগুলো তাদের সেভাবে আন্দোলিত করে না। তাদের অনেকেই বাংলাদেশকে বাংলাদেশের মতো করে চেনেন না। আর এই চেনানোর-শেখানোর জায়গাটাতে ইউরোপসহ সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্মূল কমিটির শাখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সত্যি বলতে কি আমার ধারণা আমাদের দূতাবাস আর আওয়ামী লীগের শাখাগুলো বাদ দিলে দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির এমন সরব উপস্থিতি আর নেই।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নির্মূল কমিটির আরও নানামুখী কর্মকাণ্ড রয়েছে। অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে নির্মূল কমিটির শাখা আছে পাকিস্তান আর ভারতেও। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অমীমাংসিত ইস্যু ইয়ত্তাহীন। একাত্তর পরবর্তী পাকিস্তানের একের পর এক সরকার বাংলাদেশের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো নির্লজ্জভাবে বড়খেলাপ করেছে। বিচার হয়নি যুদ্ধাপরাধী পাকসেনাদের, ক্ষতিপূরণও পায়নি বাংলাদেশ। আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়া তো দূরে থাক, একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার উদারতাটুকুও এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি পাকিস্তান। আর এসব বিষয়ে পাকিস্তানের সিভিল সোসাইটিতে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কিন্তু নির্মূল কমিটি পাকিস্তান শাখাটিই।

অন্যদিকে নির্মূল কমিটির ভারতীয় শাখার ভূমিকা একেবারেই ভিন্নধর্মী। এ কথা সর্বজনবিদিত যে বাংলাদেশে যেমন রয়েছে ভারতবিরোধী প্রচারণা, তেমনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলার লোক সেদেশেও কম নেই। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, ’৪৭-এ দেশভাগের পর থেকে এ দেশে হিন্দু জনসংখ্যা শুধুই কমেছে। বিশেষ করে যখনই আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো সরকার এদেশে ক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা খুলনার সরকারপাড়া আর যশোরের মালোপাড়ার মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছি। সঙ্গত কারণেই গত বিএনপি সরকারের সময় এদেশে হিন্দু জনসংখ্যা সর্বকালের সর্বনিম্ন আট শতাংশের তলানিতে এসে ঠেকেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। ভারতভাগের পর প্রথমবারের মতো এদেশে হিন্দু জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশের আশপাশে।


কিন্তু বাংলাদেশের আজকের এই যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি এ নিয়ে সঠিক ধারণা নেই ভারতে অনেকেরই। বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সহযোগিতা আর দুই দেশের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের যে বিশাল বাজার, পরস্পরের স্বার্থে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের উন্নতির পারদ যে আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাছাড়া এ দুই দেশের পারস্পারিক আস্থা ও সহযোগিতা আঞ্চলিক নিরাপত্তা, মৌলবাদ দমন আর বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়গুলো অনেকেরই অপছন্দের। সীমান্তের এপারের মতো ওপারেও অপপ্রচারে সক্রিয় এরা। আর এসব অপপ্রচারে জবাব দেয়া আর পাশাপাশি ভারতের জনগণ আর সুশীল সমাজের সামনে বাংলাদেশ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা তুলে ধরায় নির্মূল কমিটি ভারতীয় শাখাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।


ঠিক একইভাবে এদেশে নির্মূল কমিটি সক্রিয় আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। এদেশে যখনই সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হয়েছে তখনই পাশে থেকেছে নির্মূল কমিটি। থেকেছে মালোপাড়ায়, সরকারপাড়ায়, নাসিরনগরে আর হালের বোরহানউদ্দিনেও। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন-উত্তর যে হিন্দু নিপীড়ন আমরা বিএনপি সরকারগুলোর সময়ে এদেশে দেখেছি তা যেকোনো বর্বরতাকে হার মানাতে বাধ্য। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন সংখ্যালঘু নির্যাতন আধুনিক সমাজে বিরল। এই সময়গুলোতে আর পাশাপাশি সারা বছর ধরে সংখ্যালঘু আর প্রয়োজনে নিপীড়িত সংখ্যাগুরুর পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্মূল কমিটি উদ্যোগে গঠিত হয়েছে স্থায়ী চিকিৎসা ও আইন সহায়তা কমিটি।


পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিয়েও কাজ করছে সংগঠনটি। আগামীর সুন্দর ও বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নির্মূল কমিটির রয়েছে বহুমাত্রিক উদ্যোগ। মানবতাবিরোধী অপরাধে বিরুদ্ধেই যে শুধু সক্রিয় থেকেছে নির্মূল কমিটি তাই নয়, এগিয়ে এসেছে পরিবেশ সংরক্ষণেও। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি বড় অর্জন পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক আন্দোলনে নেতৃত্বে প্রদান। আর প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের সমর্থনে দেশে-বিদেশে নির্মূল কমিটির আছে নানামুখী আয়োজন। দেশে ত্রিশ লাখ শহীদের স্মরণে নির্মূল কমিটির ত্রিশ লাখ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের চত্বরে নিজ হাতে গাছ লাগিয়ে।

হালের রোহিঙ্গা সমস্যার একটি অর্থবহ সমাধান খুঁজে বের করায়ও নির্মূল কমিটির উদ্যোগ লক্ষণীয়। মিয়ানমারের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিষয়ে সে দেশের ইতিবাচক জনমত গড়ে তোলায়ও ভূমিকা রাখছে সংগঠনটি। অন্যদিকে নির্মূল কমিটির উদ্যোগে গঠিত গণতদন্ত কমিশন এবারের রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হওয়ার পরপরই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সরেজমিনে তদন্ত কাজ চালায়। আমার নিজেরও সুযোগ হয়েছিল এই কমিশনের সাথে কুতুপালং আর বালুখালীর শিবিরগুলোতে যাওয়ার। ১০ হাজারেরও বেশি নির্যাতিত রোহিঙ্গার যে সাক্ষ্য এখন নির্মূল কমিটির হেফাজতে আছে তা যেকোনো আন্তর্জাতিক আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করায় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।


রোহিঙ্গা সমস্যার আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ‘আরসা’সহ নানা মৌলবাদী গোষ্ঠীর সক্রিয় উপস্থিতি। ‘আইএস’ যে এই ইস্যুকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশ নিয়ে একটি নতুন খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে এনিয়ে তারা অন্তত কোনো রাখ-ঢাক করেনি।

আর একাত্তরে পাকিস্তানের বিপর্যয়ে যাদের আশাভঙ্গ হয়েছিল গুটিকয় ফাঁসি আর জামায়াতে ইসলামের নিবন্ধন বাতিলে তারা বিলুপ্ত হয়েছে এমনটি মনে করারও কোনো কারণ নেই। আমরা যদি মনে করে থাকি যে একাত্তরে বাংলাদেশ আর আমাদের মিত্রশক্তি ভারতের সাথে যুদ্ধটা হয়েছিল শুধুই পাকিস্তানের তাহলে আমাদের চেয়ে বোকার স্বর্গে বেশি বোধহয় আর কেউ বাস করছে না। একাত্তরে পাকিস্তানের সক্রিয় সহযোগী ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙারিও। শুধুমাত্র রাজাকার বাহিনীতেই সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের মতো। এসব বাঙালি দালালের সহযোগিতা ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বড় বড় ক্যান্টনমেন্টে ‘ফোর্ট ফরমেশনে’ থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কখনোই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো সম্ভব হতো না।


মনে রাখতে হবে একাত্তরে যুদ্ধরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ এদেশে এসেছিল যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে-আগে। আর মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেকোনো সদস্যের চেয়ে তাদের এদেশীয় দালালদের দায়-দায়িত্ব বহুগুণ বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশের এই যে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পথচলা, হিসাব করলে দেখবেন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার টানা এগারটি বছর বিবেচনায় নিলেও এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই এদেশে ক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এরা যখনই সুযোগ পেয়েছে চেষ্টা করেছে একাত্তরে তাদের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নেয়ার। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো ইস্যুগুলো তাদের জন্য পোয়াবারো। কাজেই ঘরের কাছে খেলাফত প্রতিষ্ঠা শুধু ’আইএস-আইএসআই’-এরই স্বপ্ন নয়, এ স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশির সংখ্যাও একেবারে কম নয়। তারচেয়ে বড় কথা, সংখ্যায় এরা যাই হোক না কেন এরা এদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাদুস-নুদুস হওয়ার সুযোগ পেয়েছে দীর্ঘদিন। কাজেই শুধুমাত্র সিটিটিবি আর র্যাবের ভরসায় বসে থাকাটা হবে আত্মঘাতী। এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় সচেতন নির্মূল কমিটি আর সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সংগঠনটির শতাধিক শাখা আর লক্ষাধিক কর্মী-সমর্থক।


বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে শেখ হাসিনার হাত ধরে একাত্তরের চেতনায় একটি উন্নত কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শাহরিয়ার কবির-কাজী মুকুলদের প্রয়াস অব্যাহত থাক- আর তিনটি বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী আর প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মবার্ষিকীর প্লাটিনাম জুবিলি উদযাপন শেষে যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে, সেই বাংলাদেশ হোক পাকিস্তানি প্রেতাত্মা মুক্ত, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক, নির্মূল কমিটির ২৮ বছরে এতটুকুই প্রত্যাশা।

লেখকঃ অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
-অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

 

মুক্তআলো২৪.কম

 

আরও পড়ুন
পাঠক কলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত