বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস এবং সাবধানতা:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

মুক্তআলো২৪.কম

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ১২:৩৪ এএম, ৩০ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):

বিশ্ব যখন একটি অতিমারিতে জর্জরিত, ঠিক তখনই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে মাসটা আবার জুলাই আর তারিখটা জুলাই ২৮। এ দিনটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আবিস্কারক মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্লুমবার্গের জন্মদিন। অধ্যাপক ব্লুমবার্গ ছিলেন পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকারও আবিস্কারক। এই টিকাটি সারা পৃথিবীতে অসংখ্য অজস্র মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, ঠেকিয়েছে লিভারের ক্যান্সার আরো অনেক মানুষের। কারণ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষ করে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয়, লিভার ক্যান্সারের প্রধানতম কারনই এই ভাইরাসটি। অথচ এই যুগান্তকারী আবিস্কারটির জন্য ব্লুমবার্গ কোন পেটেন্ট করেননি কখনই। এই মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানীর জন্মদিনটিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই বেছে নিয়েছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে, যা সংস্থাটির অনুমোদিত আটটি মাত্র দিবসের অন্যতম।

এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘হেপাটাইটিস - আর অপেক্ষা নয়’। প্রশ্ন হচ্ছে চলমান প্যান্ডেমিকের মধ্যে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো হেপাটাইটিস যে আর একটি মুহূর্তও অপেক্ষা করার সময় নেই আমাদের ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এদেশে প্রতি বছর হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসজনিত লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় বিশ হাজার মানুষ, যা এই প্যান্ডেমিকে এ পর্যন্ত এদেশে যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়েও ঢের বেশি। আর কোভিড অতিমারিতে যখন বিঘ্নিত হচ্ছে নন-কোভিড স্বাস্থ্যসেবা তখন এই সংখ্যা যে বাড়ছে বৈ কমছে না তাতো বলাই বাহুল্য।

আর মৃত্যুর এই মিছিল যদি কমিয়ে আনতে হয়, তাহলে সবার আগে যে কাজটি হবে তাহলো মানুষকে সচেতন করা যেন তারা পরীক্ষা করে জেনে নেন তাদের হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস ইনফেকশন আছে কিনা। কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে যারা ইনফেকটেড, তাদের শতকরা পাঁচ শতাংশও জানেন না যে তাদের লিভারে জ্বলছে এই ‘তুষের আগুন’। এর কারণটাও অবশ্য সঙ্গত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেইতো ভাইরাস দুটো রোগের কোন লক্ষণ তৈরি করে না, এমনকি লিভারটা অনেকখানি আক্রান্ত হয়ে গেলেও না। আর এই সচেতনতা তৈরির কাজটা যে কি পাহাড়সম তাতো কোভিডই আমাদের চোখে আগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। তবে শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়। যারা সচেতন হয়ে এগিয়ে আসবেন তাদের জন্য সহজে আর সুলভে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা নেগেটিভ রিপোর্ট পাবেন তাদের জন্য চাই সুলভে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন আর পজিটিভ হলে লাগবে সস্তায় ওষুধ আর সহজে লিভার বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ।

এক্ষেত্রে যে আমাদের প্রস্তুতি একদমই খারাপ তাও কিন্তু না। প্যান্ডেমিকটি শুরু হবার আগেই আমরা আমাদের পাঁচ বছর বয়সীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি’র সংক্রমণ এক শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পেরেছি যা একটি বড় অর্জন আর এর স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। আমাদের রয়েছে একটি অত্যন্ত সফল টিকাদান কর্মসূচি আর সাথে সরকারের হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে আছে একটি অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি-ও। দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে লিভার রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্র। ২০০৯ সালে যেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বভার গ্রহন করেন, সেদিন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে লিভার বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের একটি শূন্য পদ ছিল, আর আজ তা বেড়ে গিয়ে সারা দেশে ত্রিশ ছুঁই ছুঁই।

এক সময় শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই হেপাটোলজিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ ছিল আর এখন এ বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করা যায় পাশাপাশি বাংলাদেশ কলেজ অবস ফিজিসিয়ানস এন্ড সার্জনস এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেও। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশর সকল সেক্টরে যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি তার ছোঁয়া যেহেতু লেগেছে আমাদের ওষুধ শিল্পেও। এদেশে তৈরি ওষুধ যেমন একদিকে রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর একশটিরও বেশি দেশে, তেমনি অন্যদিকে দেশের মানুষও হেপাটাইটিস বি, সি, লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারের যাবতীয় আধুনিক ওষুধ পাচ্ছে শুধু যে দেশে বসেই তাই নয়, বরং অনেক কম খরচেও।

তারপরও এ কথা মানতেই হবে আমাদের যেতে হবে এখনও বহুটা পথ। কারণ সময় হাতে মাত্র নয় বছর। এসডিজির অন্যতম গোল হচ্ছে ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূল করা। বাংলাদেশ যেহেতু পৃথিবীর বাইরে নয়, এমডিজিগুলো অর্জনের সাফল্যের কথা মাথায় রেখে আমাদেরও এই কাজটি করেই ছাড়তে হবে। কাজটা এমনিতেই কত কঠিন আর তার উপর বাড়তি ঝামেলা হিসেবে জেকে বসেছে কোভিড প্যান্ডেমিক। আর এই যে চিত্রপট, এটি কিন্তু মোটামুটি কম বেশি একই রকম বিশ্বব্যাপী। এই প্রেক্ষাপটেই এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্যে তাই হেপাটাইটিস নিয়ে এত তাড়াহুড়া।

এদেশে লিভার রোগের স্টেক হোল্ডার কারা হিসাব কষতে বসলে বাদ যাবেনা কেউই। আমরা কেউ হেপাটাইটিসের রোগী তো কেউ চিকিৎসক আর কেউ বা ওষুধ বা ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতাল সেবার সাথে জড়িত। এর বাইরে যারা তারা সবাই ঝুঁকিতে আছি কখন বুঝি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হই। কাজেই সাধু সাবধান আর এই সাবধানতাটুকু তৈরি করার চেষ্টাতেই আজকের এই দিনে বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস।

 

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-ডিভিশনাল হেড, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

মুক্তআলো২৪.কম