এবারের ১৭ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

মুক্তআলো২৪.কম

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ১২:৫৭ এএম, ১৭ মার্চ ২০২১ বুধবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল):
১৭ মার্চ বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর অন্যতম। কারণ আর কিছু না। কারণ এই দিনটিতেই জন্মেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার হাত ধরে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে আবারও এসেছে মার্চের ১৭। তবে এবারের ১৭ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এবারের ১৭ বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতক পূর্তির। বাঙালী আজ মেতেছে তার ইতিহাসের এই অন্যতম দিন উদযাপনে। কারণ এই উদযাপনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে গুনে গুনে একশ’ বছর। বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ পূর্তিতে আজ আমাদের সঙ্গে শামিল বিশ্ব নেতারাও। আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ভুটানের রাজা, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি এবং নেপালের প্রেসিডেন্টসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি। ডিজিটাল ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন আরও অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। লকডাউনকে পেছনে ফেলে আর করোনার অনিশ্চয়তার বাতাবরণকে ঝেড়ে দিয়ে পুরো দেশ আজ উৎসবমুখর।

এই উৎসবকালে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আমার চিন্তা সামান্যই। করোনাকালে যখন থমকে গেছে পৃথিবীর তাবৎ নামী-দামী অর্থনীতি তখন সচল আমাদের উন্নয়নযজ্ঞ। শুধু উন্নয়নেই নয়, কোভিড নিয়ন্ত্রণেও বিশ্বের রোল মডেল আমরা। যে কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক কিংবা জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল সবার মুখে মুখে আজ বাংলাদেশের অর্জনগুলো আর প্রধানমন্ত্রীর অশেষ প্রশংসা। এই ধারাবাহিকতায় আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ। আমাদের এই অর্জন যে কোন মাপকাঠিতেই অসাধারণ। তবে করোনাকালে এমন অর্জনকে শুধু অসাধারণ বললে খাটো করা হয়। যদি অসাধারণের ওপরে আরও কোন কিছু থেকে থাকে তবে এই অর্জন সেই পর্যায়েরই।

কিন্তু এই অর্জনগুলোকে ব্যর্থ আর অকার্যকর প্রমাণ করার লোকেরও কোন ঘাটতি নেই। অন্ধকারের শক্তিগুলো এখনও একই রকম সক্রিয়। একাত্তরে জিতে গিয়ে আমরা মনে করেছিলাম আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। আমাদের ভুল ভেঙ্গেছিল পঁচাত্তরে আগস্টের পনেরোতে। এখন যখন আমরা আবারও ছুটছি সামনের দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে তখন চারপাশে নানারকম চক্রান্তের ঘনঘটা। এই ক’দিন আগেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে জাতিকে আরও একবার বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়ার সর্বাত্মক ব্যর্থ প্রয়াস আমরা দেখেছি। করোনাকালে ঘুমিয়ে থাকা কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙ্গেছে হঠাৎই, দেশের যখন করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি সুনিশ্চিত। নানাভাবে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা আমরা দেখেছি কিছু মানুষের মধ্যে। তাদের কারও পরিচয় রাজনীতিবিদ, কারও বুদ্ধিজীবী তো কেউ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাও। কোভিশিল্ডকে বুড়িগঙ্গার পানি থেকে শুরু করে মুরগির টিকা কত কিছুই না বলা হলো। অথচ নিজেদের ভালটা বোঝার বেলায় ষোলোআনা এই মানুষগুলো ঠিকই নিজেরা কোভিড ভ্যাকসিন নিতে একদম ভুল করেনি। এসবেরই ধারাবাহিকতায় আমরা আলজাজিরা কান্ডটি সংঘটিত হতে দেখলাম। এমন এক সময় এই অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হলো যখন রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সেনাপ্রধান আর মাত্রই এক সেনা অভ্যুত্থানে বিপর্যস্ত প্রতিবেশী মিয়ানমার। উস্কানি দেয়ার সমস্ত উপাদান আলজাজিরা কা-ে একদম স্পষ্ট। ইদানীং এদের সবকিছু ৭ মার্চকে বিতর্কিত করাকে কেন্দ্র করেই।

অপশক্তি এখন সক্রিয় নানা ফ্রন্টে। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানী হাইকমিশনারের সাম্প্রতিক ছুটোছুটির কারণ বুঝি। শুধু বুঝি না, কিভাবে তিনি এতটা আস্কারা পান এদেশে। পাকি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গভীরতর করার আজগুবি বুলিতে মুখে খৈ কেন ফোটাচ্ছেন সেটা বুঝি, কিন্তু বুঝি না তার সঙ্গে কি যুক্তিতে সুর মেলান দেশের বড় দুই শহরের ব্যবসায়ী নেতারা। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের এ্যালবাম ছাপানোর কথা তিনি কেন বলছেন সেটা বুঝি, কিন্তু বুঝি না তাকে কি যুক্তিতে এসব বকোয়াস করার সুযোগ করে দিচ্ছে ঢাকার নামী-দামী গ্যালারি। তবে এসব যত শুনি ততই বিবমিষা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জয় বাংলা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সেই ইতিহাস আমাদের জানা। আমরা অনেকেই অবশ্য ভুলে গেছি যে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের নামটাও অল্প সময়ের জন্য হয়ে গিয়েছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র, আর খুনী খন্দকার মোশতাকের ট্রেডমার্ক জিন্নাহ ক্যাপ সদৃশ টুপিটি বানানো হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক। ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ দন্ডিত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ধর্মীয় মাহফিলের নামে শোডাউন করে দাবি তুলেছিল বাংলাদেশের নাম, জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকা পরিবর্তনের। সঙ্গে দাবি ছিল শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়ারও। আর সেই দাবিগুলোর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন সেই সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত জেনারেল জিয়ার উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। আমাদের গর্বের জায়গা ৭ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিবহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সে সময় বানানো হয়েছিল শিশুপার্ক।

আজকে যখন আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে, হেসে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসবে মাতছি তখন ১৫ আগস্ট পঁচাত্তর আর তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না। আমাদের শুধু নিজেদের গৌরবগাথা প্রচার করে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না, পাশাপাশি ৪৭ পরবর্তী চব্বিশ বছরে পাকিস্তানী শোষণ আর একাত্তরের নয় মাসে এই রাষ্ট্রের বাঙালীর ওপর বর্বরতম নির্যাতন এবং তাদের এদেশীয় দালালদের সেদিনের ভূমিকার কথাও আমাদের একইভাবে জোরেশোরে উচ্চারণ করতে হবে। আমাদের দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতে হবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং তারপর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারতের ভূমিকার কথা। আমরা কেউ কেউ চীন, ভারত আর পাকিস্তানকে গুলিয়ে ফেলি। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিকও নয়। পঁচাত্তরের পর বছরের পর বছর আমাদের তো রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই মিথ্যা ইতিহাসই শেখানো হয়েছে। এখনও তো এদেশে এমন মুক্তিযোদ্ধা আর বুদ্ধিজীবী আছেন যারা জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে চার ঘণ্টা অনুষ্ঠান করেন ঠিকই, কিন্তু একবারের জন্যও জয় বাংলা বা বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন না। আমার বিশ্বাস যে সংজ্ঞায়ই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করা আর ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার মধ্যে ভারতীয় দালালের নয়, দেশপ্রেমিক বাঙালীর পরিচয়।

লেখকঃ অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল)

-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

 

 

মুক্তআলো২৪.কম