কেউটের কান ও সিভিল সোসাইটি:অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৮:৪৫ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২০ শনিবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) :
কান টানলে মাথা আসবেই’ - এই আপত্য সত্য বাক্যটি যে কত ভুল তা টের পেলাম ক’দিন আগে। গত ২৬ নভেম্বর ছিল মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার এক যুগ পূর্তি। আরব সাগরে মাছের ট্রলারে চড়ে দশ জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী একে-৪৭ আর গ্রেনেড সজ্জিত হয়ে এদিন হামলা চালিয়েছিল ঐতিহাসিক তাজ হোটেলসহ মুম্বাইয়ের একাধিক লোকেশনে। প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৬০ জনের বেশি নিরপরাধ মানুষ, যাদের অনেকেই ছিলেন বিদেশী পর্যটক। ৯ জন হামলাকারী সেদিন নিহত হলেও, গ্রেফতার হয়েছিল কাসাভ নামে একজন সন্ত্রাসী। ২০১২’তে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ভারতে।

 

এ নিয়ে একটি আর্ন্তজাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যেগে। শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায়, বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক জাফর মুহম্মদ ইকবাল, মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার, মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচক হিসেবে ওয়েবিনারটিতে আমার নামও। বলার চেয়ে শুনলাম আর শিখলাম ঢের বেশি। আর সবচেয়ে বড় কথা ‘কান টানলে মাথা আসার অসারতাটা’ আত্মস্থ করলাম। সব প্রাণির কান থাকেনা। কানের খোঁজে দিন যাবে, কিন্তু মাথার খোঁজ পাওয়া যাবেনা! কেউটের জিহ্বাই তার শ্রবণের ইন্দ্রিয়। কেউটেকে ধরতে হলে টানতে হবে তার জিহ্বাটা ধরে।

মুম্বাই বোমা হামলার নেপথ্যে ছিল মাসুদ আজহার আর হাফিজ সাইদের মত চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়াররাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানের তালেবান অধ্যুষিত কান্দাহারে। বিমানটির আরোহী ১৫৪ জন জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে ভারতের তৎকালীন বাজপেয়ী সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হন ভারতের কারাগারে বন্দী পাকিস্তানি সন্ত্রাসী মাসুদ আজহারসহ একাধিক সন্ত্রাসীকে। এই মাসুদ আজহারের জইশ ই মোহাম্মদ-ই ছিল মুম্বাই হামলার নেপথ্যে। যেমনটি ছিল হাফিজ সাইদের জামাত উদ দাওয়াও। এই সাইদ হাফিজকে মাত্র সেদিন বাধ্য হয়ে এগার বছরের কারাদন্ড দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে কালো তালিকাভুক্তি প্রায় অবধারিত জেনে তা ঠেকানোর জন্যই এই পাকিস্তানি আই ওয়াশ।

অভিযোগ আছে জেলে পাঁচ তারকা কমফোর্টে আছে হাফিজ সাইদ। পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক ডেভিড কোলম্যান হেডলি মুম্বাই হামলার অভিযোগে জেল খাটছে মার্কিন মূলকে। তার বাবা ছিলো পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা। কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার জন্য পাকিস্তান সরকার আর পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-কে দীর্ঘদিন ধরে দায়ি করে আসছে ভারত। আর অসংখ্য তথ্য-উপাত্তে আজ এটি প্রমানিত বাস্তবতা।

শুধু ভারতই না, পাকিস্তানি মদদপুষ্ঠ সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে রঞ্জিত হয়েছে এই উপমহাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্র। আমাদের দেশেও বিচারিক আদালতের রায়ে তা প্রমাণিত। দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার মামলায় আদালতে প্রমাণিত হয়েছে এসব অস্ত্রের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ হয়ে ভারতে আর এর পেছনে ছিল আইএসআই। একুশে আগস্ট ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, তার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। সেদিন স্রষ্টার অপর কৃপায় রক্ষা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। কিন্তু ঝরে গিয়েছিল আইভি রহমানসহ ২৪টি তরতাজা প্রাণ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডগুলো তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক গোলাবারুদ কারখানায় আর দেশী সন্ত্রাসীদের হাতে সেগুলো পৌঁছে দিয়েছিল আইএসআই। এ সব আমার কথা না, এ সব কথা উঠে এসেছে আদালতের রায়ে।

হালের যে হলি আর্টিজান তার পেছনেও পাকিস্তানের ইন্ধন স্পষ্ট। দেশের কোমলমতি কিশোর-যুবকদের মাথা গুলিয়ে দিয়ে তাদের দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার যে আইএসআই নীলনকশা দেশে দেশে, এদেশে হলি আর্টিজান তার একটি দৃশ্যপটের মঞ্চায়ন মাত্র। এমনকি দশ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ যে পরবাসে, তাদের উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর যে অবর্ণনীয় মানবতা বিরোধী অপরাধ, তার পিছনেও পাকিস্তানের জড়িত থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট। জাতিসংঘের পরলোকগত মহাসচিব কফি আনান কমিশনের উদ্যেগে রোহিঙ্গা সমস্যাটা যখন একটা সমাধানের দিকে যাচ্ছিল তখনই ‘কালা আদমির’ উদ্যোগটিকে ভেস্তে দিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একাধিক পোস্ট হামলা চালায় পাকিস্তান মদদপুষ্ট আরসা সন্ত্রাসীরা, যা তখন আগুনে ঘি ঢালার মতই কাজ করেছিল। সে সময় আইএসআই’র ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার সাথে আরসা সন্ত্রাসীদের কথোপকথন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল।

সত্তরের দশকে পৃথিবীর অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ছিল আফগানিস্তান। আজকের প্রজন্ম এমনি কথা শুনলে ভ্রæ কুচকে তাকাবে। পাশাপাশি একটি প্রগতিশীল, উদারনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবেও পরিচিত ছিল দেশটি। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে আফগান নেতা বারবাক কারমালের নেতৃত্বে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাবুলে। আফগান পার্লামেন্টে পাকিস্তানের নিন্দা জানিয়ে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন কারমাল। সেই আফগানিস্তানকে একটি পশ্চাদপদ, মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার পুরোটা কৃতিত্ব পাকিস্তানের। পাহাড়ে খোদাই করা বুমিয়ানের যে বৌদ্ধ মূর্তিটি ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সেটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তালেবানি কামানের গোলা। যেন পাকিস্তানি কেউটের ছোবলে-ছোবলে অসহায় আফগানিস্তানের মূর্ত প্রতীক ঘটনাটি।

শুধু বাংলাদেশ, ভারত আর আফগানিস্তানই নয়, পাকিস্তানি ছোবল থেকে মুক্তি পায়নি প্রতিবেশি শ্রীলংকাও। এইতো কদিন আগেই কলোম্বোর গীর্জা লাল হয়েছিল পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সস্ত্রাসীদের বোমা হামলায়। আর এই পাকিস্তানি কেউটের হাত বহুদুর বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যে মার্কিন মূল ভূখণ্ডে একটি বোমা ফাটেনি, নিউ ইয়ার্ক শহরের প্রাণকেন্দ্র সেই মার্কিন মুলকের গর্বের টুইনটাওয়ার ধসিয়ে দিয়েছিল ওসামা বিন লাদেন। লাদেনকে পরে বহু বছরের সাধনায় মার্কিনীরা খুঁজে পায় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামবাদের বগলের তলায় দেশটির প্রধান সেনানিবাস শহর এবোটাবাদে। যেখানে পাকিস্তানি সেনা গেয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে একটা মাছিও ঢুকতে পারার কথা নয়, সেখানে তাদের না জানিয়ে সপরিবারে জেঁকে বসেছিল লাদেন, এ কথাতো পাগলও বিশ্বাস করবে না।

এটি এখন পানির মতই স্বচ্ছ যে, এই উপমহাদেশে সন্ত্রাসের একক উস্কানি আর মদদদতা পাকিস্তান। তবে কান টানলে এর মাথা আসবে না, একে ধরতে হলে টানতে হবে জিহ্বাটা ধরেই। কান খুঁজলে খোঁজাই সার হবে, মাথার দেখা মিলবে না, কারণ কেউটের কান থাকেনা। আর এই কেউটেকে যদি একেবারে কুচলে দিতে হয় তবে তার জন্য আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজন এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটির ঘনিষ্ট যোগাযোগও। শুধু সরকারে-সরকারে যোগাযোগ আর সহযোগিতা কেউটের কান খোঁজার সামিল হবে। প্রগতিশীল সিভিল সোসাইটির মধ্যকার যোগাযোগ দেশে দেশে যেমন মৌলবাদের বিস্তার রোধ আর জনগোষ্ঠিকে সচেতন করে তোলায় অপরিহার্য, তেমনি তা পাশাপাশি আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার সম্পূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা কিন্তু এ কাজটাই করছে।

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

 

 

মুক্তআলো২৪.কম