পিরোজপুরের ভাগীরথী থেকে ধর্ষণের শাস্তিতে সবখানেই দ্বিমত:

মুক্তআলো২৪.কম

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৫:৫৮ পিএম, ২ নভেম্বর ২০২০ সোমবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
একাত্তরের ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি খবর কয়েক দিন আগে আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম। পিরোজপুরের ভাগীরথীর কথা। একাত্তরের মে মাসে ভাগীরথীর গ্রামে গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বিধবা ভাগীরথীকে উঠিয়ে নিয়ে যায় তারা পিরোজপুরের তাদের ক্যাম্পে। সেখানে আটকে রেখে তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। ভাগীরথী প্রথমে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, পরে সিদ্ধান্ত পাল্টান। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। একপর্যায়ে তার গ্রামে ফিরে যাওয়ার অনুমতিও জোটে। গ্রাম থেকে ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করতেন ভাগীরথী নিয়মিত। এই সুযোগে তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। জুন মাসের কোনো একদিন ভাগীরথী পিরোজপুর ক্যাম্পের পাক সেনাদের তার গ্রামে দাওয়াত দেন। মোট ৪৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য সেই রাতে তার সেই দাওয়াতে যোগ দেয়। অতর্কিতে সেখানে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। ভাগীরথীর কাছ থেকে আগেই খবরটি পেয়েছিল তারা। আনুমানিক ৪০ জন পাক সেনা সেদিন মারা যায়। পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল এর পেছনে ভাগীরথীর হাত আছে। তার মাথার দাম ঘোষণা করা হয় ১০০০ রুপি। একসময় ধরাও পড়েন ভাগীরথী। ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। তারা তাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

জুন মাসের কোনো একদিন সকালে ভাগীরথীকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা হাজির হয় পিরোজপুর শহরের চৌমাথায়। সেখানে প্রকাশ্যে তাকে বিবস্ত্র করে তারা। তারপর একটা পাক আর্মি জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে ভাগীরথীকে বেঁধে, টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে পিরোজপুর শহরটা প্রদক্ষিণ করে আবার চৌমাথায় ফিরে আসে পাকিস্তানি জিপটা। তখনো ভাগীরথী বেঁচে আছেন। এরপর তার দুটো পা দুটো আলাদা জিপের পেছনে বেঁধে দুটো আলাদা দুদিকে চালিয়ে দেয়া হয় জিপ দুটি। মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুচ্চারিত আরেকটি অধ্যায়।

ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাসটি দেখার পর অনেকে কমেন্ট করেছেন, শেয়ারও করেছেন কেউ কেউ। তাদের একজনের কমেন্টটা অনেকটা এ রকম - ‘ঘটনাটা লেখকের বানিয়ে বলা’, লিখছে লোকটি। তার বক্তব্য অনুযায়ী সে ভাগীরথীর হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তার ভাষায় সে সময়ে পিরোজপুর শহরে কোনো রাস্তা ছিল না। পাকিস্তানি আর্মির ছিল না কোনো জিপও। ভাগীরথীকে চৌমাথায় বিবস্ত্র করে পাকিস্তানি সেনারা একটি মোটরসাইকেলের পেছনে তাকে বেঁধে, টেনেহিঁচড়ে পিরোজপুর শহরটা প্রদক্ষিণ করেছিল। তারপর নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে ভাগীরথীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লোকটির কমেন্টটি পড়ে মন্তব্য করছে আরেকজন, ‘ইতিহাস বিকৃত করার এমন অধিকার মামুন আল মাহতাবকে কেউ দেয়নি!’

দুই.
শখ করে একটা প্রাডো জিপ কিনেছিলাম বছর দুয়েক আগে। শখ করেই মাঝেসাঝে বের করি ওটা। পেশায় আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোনো দিনে প্রাডোতে চড়ে যাই। তবে বেশির ভাগ দিনই যাই আমার মেয়ের কাছ থেকে ধার করা এক্স করোলাটা নিয়ে। আমাদের কেবিন ব্লকটা এখন কোভিড হাসপাতাল। হাসপাতালে তাই ঢুকতে হয় পেছন দিক দিয়ে, সাকুরার পাশের গলিটা ধরে। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি আছে। সেটাই সংগত, প্রশংসনীয় বটে। প্রতিদিনই গেটের সামনে কর্তব্যরত আনসার আমার এক্স করোলাটা দাঁড় করায়। আমার পরিচয়টা জানতে চায়। উত্তর দিই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লিভার বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান। আনসার তারপর সালাম দিয়ে গেটটা খুলে দেয়। ব্যতিক্রমটা হয় যখন প্রাডোটা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। লম্বা সালাম দিয়ে আনসার সহাস্যে গেটটা খুলে দেয়। আমিও বিনা বাধায়, বিনা বাক্যব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ি!

তিন.

আমার নিত্যদিনের যাতায়াত এয়ারপোর্ট রোডটা ধরে। তা সে বিএসএমএমইউ-ই হোক বা আমার বৈকালিক কর্মস্থল ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল। পথে অবধারিতভাবে গাড়িটা দাঁড়ায় বিজয় স্মরণী সিগন্যালে। ঢাকায় ইদানীং ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক কম। আগের মতো মোড়ে মোড়ে আর ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামামাত্রই জেঁকে ধরে না ভিখারির দল। আমার ধারণা, আমার এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হবেন বেশির ভাগ মানুষ। ব্যতিক্রম শুধু এই বিজয় স্মরনী সিগন্যালটা। এখানে দু-চারজন ভিখারি সব সময়ই থাকে। আমার প্রাডোটা এই সিগন্যালে থামলেই বন্ধ গ্লাসে নক করে সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের কেউ কেউ। ব্যতিক্রম শুধু এক্স করোলার বেলায়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ সাহায্য চায়। বেশির ভাগ সময়ই চায় না!

চার.

ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে কয়েক দিন আগে ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল শাহবাগ। দাবি একটাই, ‘ধর্ষকের জন্য ফাঁসির চেয়ে কম কিছু নয়’। বুদ্ধিজীবী থেকে শিক্ষক, সবাই রাস্তায় নেমেছিলেন এই একই দাবি নিয়ে। প্রেসক্লাব থেকে মফস্বলের চৌমাথা- সবখানেই একই দাবি, একই আওয়াজ। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে তেমনি এক প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন কিছু বুদ্ধিজীবী। তাদেরই একজনকে বলতে শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী আইন করে ফাঁসির ব্যবস্থা করবেন আর ধর্ষকরা ফাঁসিতে ঝুলে অতো সহজে পার পেয়ে যাবে, এটা হতে দেয়া যাবে না। ধর্ষকের জন্য চাই ৫০ বছরের জেল!

পাঁচ.

শাহবাগ যখন ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল, প্রেসক্লাবের সামনে তখন একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর ধর্ষক প্রেম, ধর্ষকের জন্য ফাঁসির বদলে জেলের দাবিতে তাদের ধরনা। আর আমাদের কোনো কোনো মিডিয়ায় এই দুই ধরনের খবরই প্রচারিত হতে দেখলাম সমান গুরুত্ব দিয়ে! 

সম্প্রতি বন্ধুপ্রতিম অগ্রজ, বিশিষ্ট সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান ভাই তার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসের প্রতিপাদ্য তার পেশার সাম্প্রতিক দীনতা। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু জাকারিয়া স্বপন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তার আরেকটি পরিচয় সে একজন সুলেখক। লেখে চমৎকার। সম্প্রতি এই সারাক্ষণ ডটকমেই তার আরেকটি চমৎকার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। স্বপন লিখেছে, ‘আমাদের দেশে সৃজনশীলতার যে ঘাটতি, তা পূরণে অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে আরো বিশটি বছর।’  

নাইম ভাইয়ের স্ট্যাটাস বা স্বপনের লেখার যৌক্তিকতা প্রমাণ আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাদের অবজারভেশনের সঙ্গে একমত হতে পারেন অনেকে, দ্বিমতও থাকতে পারে অনেকেরই। আমাদের মানসিকতায় আজকে যে অসুস্থতা, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে ভিখারি- সবার চিন্তার এই যে দীনতা, আমি ভাবছি সেখান থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়? কীভাবে? কবে? স্বপনের মতো আমি জোর দিয়ে বলতেও পারছি না যে আর বিশটি বছর পরেই আমরা এ থেকে মুক্তি পাব। তবে একটা কথা বলি- এর পরেরবার যখন দেশ বা সরকারকে কোন ব্যাপারে গালি দেবেন, তার আগে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নেবেন। এটা শুধু আপনার জন্যই না, প্রযোজ্য আমার বেলাতেও।  

লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

বিষয়:

 

 

মুক্তআলো২৪.কম