কভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০১:১৭ পিএম, ২৮ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার

অধ্যাপক  ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল:
আজ ২৮ জুলাই—বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো এই দিনটি উদ্যাপিত হয়। তারপর হাঁটি হাঁটি পায়ে পার হয়ে গেছে ১০টি বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত হাতে গোনা আটটি দিবসের অন্যতম এটি। ১৯৬৫ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীর রক্তে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস শনাক্ত হয়। আবিষ্কারক মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্লুমবার্গ। তিনি পরে হেপাটাইটিস ‘বি’র প্রথম টিকাটিও আবিষ্কার করেন। এটি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকর সর্বপ্রথম টিকা। এই অনবদ্য আবিষ্কার দুটির জন্য অধ্যাপক ব্লুমবার্গ ১৯৭৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। অধ্যাপক ব্লুমবার্গ তাঁর আবিষ্কৃত টিকাকে পেটেন্ট না করে বিশ্বমানবের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। আর সে কারণেই অধ্যাপক ব্লুমবার্গের জন্মদিনে ২৮ জুলাই প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী উদ্যাপিত হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৫ কোটিরও বেশি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। অন্যদিকে পৃথিবীতে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২০ কোটির মতো। হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস অবশ্য আবিষ্কৃত হয় ‘বি’ ভাইরাসের অনেক পরে, ১৯৮৯ সালে।

রক্ত আর অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস ছড়ায়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস ‘সি’ ছড়ায় মূলত রক্তের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তমাখা সুইয়ের খোঁচায় ভাইরাসটি সংক্রমণের আশঙ্কা শতকরা ৩০ ভাগ আর হেপাটাইটিস ‘সি’র ক্ষেত্রে তা শতকরা তিন ভাগ। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তানের জন্মের পর পর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৯০ শতাংশ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাস ছড়ায় না। রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী, যেমন—গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামাকাপড় ইত্যাদির মাধ্যমেও এই দুটি ভাইরাস ছড়ায় না।
বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে সংক্রমিত। তাদের মধ্যে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’তে আক্রান্ত। আর এ দেশে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এসব আক্রান্ত রোগীর অনেকেই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে আছে।

পাশাপাশি হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রোগীরা ভাইরাস দুটির রিজার্ভার হিসেবে থেকে যায়। তাদের কাছ থেকে যেকোনো সুস্থ লোকের এই দুটি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে। মহিলা, গর্ভবতী মা এবং নবজাতক শিশুদের বেলায় হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি।

আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—এ দেশে প্রায় ২৯ হাজার লোক প্রতিবছর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী শুধু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত এ দেশের ১০ শতাংশ লোকের চিকিৎসা ব্যয় বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এককথায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুবই বড় ধরনের সমস্যা।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ইতিহাস থাকে না। ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হন ১০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি আর প্রায় ৯০ শতাংশ শিশুর লিভারে স্থায়ী ইনফেকশন দেখা দেয়। অন্যদিকে ৯০ শতাংশ মানুষের লিভারে হেপাটাইটিস ‘সি’ ক্রনিক হেপাটাইটিস তৈরি করে। এ ধরনের রোগীদের প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। তারা কখনো কখনো পেটের ডান পাশে ওপরের দিকে ব্যথা, দুর্বলতা কিংবা ক্ষুধামান্দ্যর কথা বলে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে যাওয়ার সময় রক্ত পরীক্ষা করাতে গিয়ে কিংবা রক্ত দিতে অথবা ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে রোগীরা তাদের হেপাটাইটিস ‘বি’ কিংবা ‘সি’ ভাইরাস ইনফেকশনের কথা জানতে পারে।

ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আরো অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ। আর ‘সি’র অবস্থান তার পরপরই। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও অ্যাডভান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীরা প্রায়ই কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ার পর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস ইনফেকশনের চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও রোগীদের অনেক ক্ষেত্রেই আর সেভাবে সাহায্য করা সম্ভব হয় না।

বর্তমানে বিশ্ববাজারে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন রয়েছে। বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের আন্তর্জাতিক মানের একাধিক ভ্যাকসিন। অবশ্য ‘সি’ ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান, হেপাটাইটিস ‘বি’ রোগীর স্বামী বা স্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং থ্যালাসেমিয়া ও অন্যান্য হেমোলাইটিক এনিমিয়ার রোগীদের জন্য হেপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আর বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণের হার যথেষ্টই বেশি, সেখানে প্রত্যেক নাগরিকেরই উচিত হেপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়া। তবে ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কোনো ভালো জায়গা থেকে। কারণ ঠিকমতো সংরক্ষণ করা না হলে এই ভ্যাকসিন কোনো উপকারেই আসে না।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আজ আর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়। লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেওয়ার আগে এটি ধরা গেলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির নিরাময়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। পৃথিবীতে আজ এই দুটি ভাইরাসের জন্য বেশ কয়েকটি ওষুধ রয়েছে, যার সবই বাংলাদেশেও সহজলভ্য। সুসংবাদ এই যে আমাদের দেশীয় একাধিক ওষুধ কম্পানি এই ওষুধগুলো শুধু তৈরিই করছে না, সেগুলো পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে রপ্তানিও করছে।

পাশাপাশি এ দেশের গবেষকদের গবেষণার ফলাফললব্ধ হেপাটাইটিস ‘বি’র নতুন ওষুধ ‘ন্যাসভ্যাক’ হেপাটাইটিস ‘বি’ চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে আর এর কার্যকারিতাও অনেক বেশি। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী লিভার রোগ নিয়ন্ত্রণে ন্যাসভ্যাক সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরই মাঝে কিউবাসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার একাধিক দেশে ওষুধটি বাজারজাত হচ্ছে। জাপানে বর্তমানে ন্যাসভ্যাকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ন্যাসভ্যাকের রেসিপি অনুমোদন করেছে। আশা করা যায়, দ্রুতই বাংলাদেশে ওষুধটির ব্যবহার শুরু হবে। ন্যাসভ্যাক হচ্ছে বাংলাদেশে ডেভেলপ করা প্রথম ওষুধ, যা বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে।

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য আশাব্যঞ্জক অনেক কিছুই আছে। কিন্তু হতাশার জায়গাটা হচ্ছে এই যে এখন পর্যন্ত হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ শতাংশ মানুষও জানে না তারা এই ভাইরাসগুলোতে আক্রান্ত। এরই মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস নির্মূলের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২৮ জুলাই সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। আজকের কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে এই দিবসের গুরুত্ব অনেক বেশি। কভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে এটি দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না—এমন অদৃশ্য ভাইরাস কিভাবে গোটা পৃথিবীকে থমকে দিতে পারে। রাতারাতি কিভাবে বদলে যেতে পারে আমাদের জীবনযাত্রা। কভিড সংক্রমণে এই দেশে এ পর্যন্ত আমরা দুই হাজারের কিছু বেশি মানুষকে হারিয়েছি। অথচ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর শুধু বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে এই রোগগুলো সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে ভাইরাস দুটিকে পৃথিবী থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় করা। আর আমাদের তা করতে হবে শুধু এসডিজি গোল অর্জনের তাগিদ থেকে নয়, বরং নিজেদের তাগিদেও। তা না হলে কভিডের চেয়েও বড় কোনো দুর্যোগ যে আসবে না, তা কেউই হলফ করে বলতে পারে না।

লেখক: 
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
 -চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-চেয়ারম্যান, ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশ এবং -সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।


মুক্তআলো২৪.কম