আজকের করোনা, কালকের করোনা:অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) 

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) 

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৩:২০ এএম, ১৭ মে ২০২০ রোববার

অধ্যাপক  ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

 

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):
চীনের উহান থেকে পৃথিবীব্যাপী সার্স কোভ-২ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার শিরোনামটি এখন পাঁচ মাসের বেশি পুরোনো। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ হানা দেয়ার দুই মাস পূর্তিও হলে গেল ক’দিন আগেই। পৃথিবীর আর ২১১টি রাষ্ট্র এবং অঞ্চলের মতোই কোভিডের সহসা ধাক্কায় হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠে আর সবার মতো আমরাও এখন প্রস্তুতি নিচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে কোভিড-১৯ মোকাবিলার। ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯-এর মতোই কোভিড-উত্তর সময়টা অর্থাৎ কোভিড-২০-২১মোকাবিলাটাও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে। এর একটি দিক হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতি। আর এই লেখার গণ্ডিটাও সেই জায়গাটাকে কেন্দ্র করেই।

জানুয়ারিতে প্রথম যখন কোভিড-১৯ নামক রোগটি বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল সেই সময়টার তুলনায় আজকে আমদের অস্ত্রাগার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। তখন কোভিড-১৯-এর ওষুধ বলতে ছিল জ্বর-কাশি আর শ্বাসকষ্টের সিম্পটোমেটিক চিকিৎসা। সে জায়গায় আজ আলোচনায় অনেকগুলো ওষুধ। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আছে তিনটি, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ফেভিপিরাভির, রেমডেসিভির।

এর মধ্যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের সাথে আছে বাঙালির নাড়ির যোগ। আজকের বাংলাদেশের যশোরের সন্তান আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় গত শতাব্দীর শুরুতেই বাগেরহাটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস- এই উপমহাদেশের প্রথম ওষুধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পরবর্তীতে যা স্থানান্তরিত হয় পশ্চিমবঙ্গে। আজও পৃথিবীর বৃহত্তম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদনকারী দেশ ভারত। পৃথিবীর ৭০% হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন আসে ভারত থেকেই। ওষুধ শিল্পের যে বীজ একদিন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র বপন করেছিলেন বাংলার মাটিতে,আজকের বাংলাদেশ গর্বিত ভঙ্গিমায় তার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই পৃথিবীর প্রথম জেনেরিক ফেভিপিরাভির ও রেমডিসিভির উৎপাদিত হয়েছে বাংলাদেশে। ফেভিপিরাভির বা রেমডিসিভির দিয়ে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যখন পৃথিবীর উন্নততম দেশগুলোর কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য লটারি জেতার মতো, তখন আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালে সেসব ওষুধ এখন রোগীরা পাচ্ছেন বিনামূল্যে।

শোনা যাচ্ছে পৃথিবীতে দেশে দেশে সার্স কোভ-২-এর বিরুদ্ধে শতাধিক সম্ভাব্য ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটের ট্রায়াল চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এর মধ্যে সাত থেকে আটটি খুবই সম্ভাবনাময়। এমনও শোনা যাচ্ছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি হয়তো বাজারে চলে আসবে মাসখানেকের ভেতর। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়া লিমিটেড এরই মাঝে এইভ্যাকসিনটির নয় কোটি ডোজ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের যে ঐতিহাসিক গভীরতা আর আজকের যে ব্যাপ্তি তার উচ্ছসিত বহিঃপ্রকাশ এই করোনাকালেও আমরা একাধিকবার দেখেছি। বাংলাদেশের কমপক্ষে দুটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আশা করা যেতেই পারে যে সরকারি উদ্যোগ এবং দুই দেশের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতায় পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক আগেই এই সার্স কোভ-২ ভ্যাকসিনও আমাদের হাতে চলে আসবে।

একটা সময় আমাদের খেদ ছিল টেস্ট নিয়ে। সেখানেও আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে অনেকখানি। গত মাসের এ সময়টাতেও এ দেশের একটি মাত্র পিসিআর ল্যাবে সার্স কোভ-২ পরীক্ষা করা হতো। আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১টি। পাইপলাইনে আছে আরও ১৫টি ল্যাব। বিশ্বব্যাপী সহসা চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এখন আর পয়সা থাকলেই পিসিআর মেশিন পাওয়া অত সহজসাধ্য নয়। এক্ষেত্রেও সরকার উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্স কোভ-২ পরীক্ষায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য জেলার সরকারি মেডিকেল কলেজে পিসিআর মেশিন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পিসিআর পরীক্ষায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে নন-মেডিকেল পোস্টগ্র্যাজুয়েটদেরও। বর্তমানে যে পিসিআর ল্যাবগুলো সক্রিয় আছে, দক্ষ লোকবল বাড়িয়ে সেগুলোকে পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করা গেলে এদেশে প্রতিদিন ১০ হাজার সার্স কোভ-২ টেস্ট করার আমাদের যে প্রত্যাশা তা বোধ করি আর ক’দিনের বেশি অপূর্ণ থাকবে না।

অনেক কথা হয়েছে ভেন্টিলেটার নিয়েও। ৬৫টি দিন সময় পেয়েও বিদেশ থেকে কেন ভেন্টিলেটার আনা হলো না, এনিয়ে গরম-গরম আলোচনা কম হয়নি। গুলিয়ে ফেলা হয়েছে আইসিইউ আর ভেন্টিলেটারকে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে থ্রিএম কোম্পানিকে বাধ্য করেছেন ইউরোপে এন-৯৫ মাস্কের চালান বাতিল করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ করতে আর চাপ দিয়ে ভারতের কাছ থেকে আদায় করেছেন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সেখানে বাংলাদেশ কীভাবে বিশ্ব বাজার থেকে ভেন্টিলেটার সংগ্রহ করবে সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়। কারণ ভেন্টিলেটারের যারা উৎপাদনকারী রাষ্ট্র তারাইতো কোভিড আক্রান্ত রোগীদের সামলাতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে এগিয়ে এসেছে আমাদের স্থানীয় ভারী শিল্প। দেশে এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি ভেন্টিলেটারের প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি আর ওয়ালটনের স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ভেন্টিলেটারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হতে যাচ্ছে ঈদের পরপরই। আশা করা যায় দেশে উৎপাদিত ভেন্টিলেটার দিয়েই আমরা এক্ষেত্রে আমাদের যে সীমাবদ্ধতা তা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পারব।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাঁচ মাস আগে আমরা যেখানে ছিলাম ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার তার তুলনায় আমাদের আজকের অবস্থানটা হয়তো অনেক সুসংহত কিন্তু এর কোনোটই কিন্তু চূড়ান্ত সমাধান নয়। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ফেভিপিরাভির কিংবা রেমডেসিভিরের প্রতিটি সার্স কোভ-২-এর বিরুদ্ধে কমবেশি কাজ করে এ কথা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি যে কোভিড-১৯-কে পুরোপুরি সারিয়ে তোলার মতো ওষুধ এখনও আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

অক্সফোর্ডের যে বহুল আলোচিত ভ্যাকসিন তার আবিষ্কারক নিজেই বলেছেন তার প্রত্যাশা এটি সর্বোচ্চ ৮০% কার্যকর হবে। কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে খুব কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও সে ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। লাগতে পারে তারচেয়েও বেশি সময়। আমরা এক স্মলপক্সকেই শুধু বিদায় করতে পেরেছি। পোলিও এখনও উকি দেয় ইতি-উতি আর হেপাটাইটিস-বি বা হাম-তো রয়ে গেছে বহাল তবিয়তেই। গত বুধবার জেনেভায় ডব্লিওএইচও-র নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির বিশেষজ্ঞ মাইক রায়ানের বক্তব্য এমনই ছিল।

মাঝে কোভিড-১৯ নিয়ে যেকোনো আলোচনায় সবার আগে আসত পারসোনাল প্রকেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিইর বিষয়টি। পিপিই সংকটে শুরুর দিকে কোভিড-১৯-এর কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছেন এদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা। বারবার মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রশাসনকেও। আজকের পরিস্থিতি অবশ্য অন্যরকম। বাংলাদেশ এখন পিপিই রফতানির স্বপ্ন দেখে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, সংবাদকর্মী, পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য ফ্রন্টলাইনারদের যৌক্তিক ব্যবহারের পাশাপাশি পিপিই পরে কাঁচাবাজারে যাওয়ার বিলাসিতা পৃথিবীতে সম্ভবত শুধু বাংলাদেশিরাই আজ দেখাতে পারছে।

কিন্তু একটা বিষয় সম্ভবত আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে পরিমাণ পিপিই সরবরাহ করেছে শুধু তা থেকেই ১৮ লক্ষ ৭০ হাজার কিলোগ্রাম অত্যন্ত সংক্রামক মেডিকেল বর্জ্য জড়ো হয়েছে। আর এসব সামগ্রী বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয় বিধায় এগুলোই পরবর্তীতে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দেখা দেবে। পাশাপাশি ব্যবহৃত গ্লাভস, মাস্ক আর পিপিই ধুয়ে-মুছে আবারও যে বাজারে ছাড়তে সক্রিয় একটি চক্র সক্রিয় সেটাও আমরা জানতে পারছি মিডিয়ার কল্যাণে। এসব কিছু মরার ওপর খাঁড়ার ঘা বৈ অন্য কিছু না।

কাজেই এটা ভুলে গেলে চলবে না যে পাঁচ মাস আগের তুলনায় আমাদের আজকের প্রস্তুতি অনেক ভালো মানে এই নয় যে কোভিড ওই গেল বলে। বরং আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে যে সমস্যাটি আমাদের সাথে থাকবে আরও বহুদিন। আর সেই বহুদিন যে কতদিন তা নির্ভর করবে অনেকটাই আমাদের ওপর। আমরা ব্যবহৃত পিপিইটা নিয়ে কী করছি কিংবা শারীরিক দূরত্বটা ঠিকমতো বজায় রাখছি কি না, তার ওপর নির্ভর করবে আর কতদিন পর্যন্ত আপনার-আমার শপিং সেন্টারে যাওয়াটাকে মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না।

আজ আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে নিজের সচেতন হওয়ার চেয়ে কোভিড-১৯-এর জন্য আরও বড় কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও মানুষের কাছে অজানা। কাজেই আবারও সেই পুরোনো কথা সচেতন হোন এবং ভালো থাকুন।

 

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) 
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

 

মুক্তআলো২৪.কম