ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবার হাতছানি আজকেই

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৭:২৬ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

 

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):আমার প্রয়াত প্রকৌশলী বাবা তাঁর কর্মজীবনের শেষ সময়টা কাটিয়েছিলেন যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের (বর্তমানে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। সে সময়ে বাবার চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশেই যমুনার ধারে কর্তৃপক্ষের অদ্ভুত সুন্দর স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। যত দূর মনে পড়ে, সেখানে ছোট একটি  জাদুঘরও ছিল। তবে যত দূর মনে পড়ে, এই জাদুঘর থেকেই প্রথম জেনেছিলাম বাংলাদেশের একসময়কার স্বপ্ন প্রজেক্ট এই বঙ্গবন্ধু সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তেমনি আজকের এই যে পদ্মা সেতু, এটিও কিন্তু জাতির পিতার পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন মাত্র। এমনকি আজকে মহাকাশে আমাদের মুখ উঁচু করে ছুটে বেড়াচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, এরও বীজটা বপন করেছিলেন জাতির পিতাই তাঁর সাড়ে তিন বছরের স্বল্পস্থায়ী শাসনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু অল্প যে কয়দিন এই দেশটা শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই সময়েই তিনি এ দেশটির ভবিতব্য নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। মনে আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, তিনি যখনই কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বসেন, পুরনো ফাইল ঘাঁটতে গেলেই দেখেন যে এসব প্রকল্পের শুরুটা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

যে দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক সত্তরের দশকের শুরুর দিকে পদ্মা সেতু কিংবা মহাকাশে উপগ্রহের পরিকল্পনা করেছেন, স্বাস্থ্য খাত তাঁর পরিকল্পনার তালিকায় ওপর দিকেই ছিল। আর আজ আমরা দেশের সব খাতের মতো এই খাতেও যে উন্নয়নের জোয়ার দেখি, তার সবটাই বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার ওপর দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, ‘যার ব্যথা সে-ই বুঝে সবচেয়ে ভালো।’ পাশাপাশি পেশার সম্মান ছাড়া কোনো পেশাজীবীর কাছ থেকে শুধু অর্থের বিনিময়ে পেশাগত উত্কর্ষ প্রত্যাশা করাটাও অমূলক।

পাশাপাশি ভেঙে দুই ভাগ করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। ফলে স্বাস্থ্য প্রশাসনেও আসছে গতিশীলতা। শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১১ বছরে এ দেশে জুনিয়র কনসালট্যান্ট থেকে সিনিয়র কনসালট্যান্ট আর সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক অবধি পদোন্নতিপ্রাপ্ত চিকিত্সকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।

বঙ্গবন্ধু জানতেন, দেশের সব মানুষের সুচিকিত্সা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বাড়াতে হবে তাঁদের প্রশিক্ষণের মান। গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে পাশাপাশি, একটির পর অন্যটি নয়। ‘ডিম আগে না মুরগি’—এই বিতর্কে না গিয়ে তিনি একদিকে যেমন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল শাহবাগে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, একসময় যা পরিচিত ছিল পিজি হাসপাতাল নামে। বঙ্গবন্ধুই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনও। পাশাপাশি দেশে মেডিক্যাল গবেষণার প্রসারের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রথম মেয়াদের শাসনকালে ১৯৯৯ সালে আইপিজিএমআরকে উন্নীত করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরও পরবর্তী ধাপে এ দেশের টারশিয়ারি স্বাস্থ্য খাতকে ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী করে তোলার তাগিদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশে চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উত্পাদিত হয়। পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রেরই এ ক্ষেত্রে এ ধরনের সক্ষমতা নেই। এই একটি কারণে এ দেশে ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পাশাপাশি আমাদের উত্পাদিত মানসম্পন্ন ওষুধ শুধু যে পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে তা-ই নয়, এ দেশের ওষুধ যাচ্ছে এমনকি যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বাজারেও।

অন্যদিকে দেশে ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সম্ভাবনা। এ দেশের বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবিত ন্যাসভ্যাকের মতো ওষুধ কিংবা এ দেশের ওষুধ কম্পানির পরীক্ষাগারে ডেভেলপ করা বায়োসিমিলার ওষুধ এখন সব নিয়ম-কানুনের বিধি-বিধান মেনেই রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে এ দেশে এবং এ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও। দেশেই সৃষ্টি হচ্ছে স্টেম সেল আর সেল থেরাপি নিয়ে কাজ করার সুযোগও। দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে একের পর এক নতুন নতুন সরকারি আর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজও। সরকারের এই উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে দেশপ্রেমিক সশস্র বাহিনীও। এরই মাঝে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর আসনসংখ্যা যথাক্রমে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ও দুই হাজারটি করে বাড়ানো হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে ২৫টি নতুন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, যার মধ্যে পাঁচটি সেনাবাহিনীর অধীনে আর ৩২টি  নতুন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। ডেন্টাল কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে ২২টি।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে তাঁর সরকারের স্বাস্থ্যনীতির মূল এসেন্সটা ছিল ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’। এ উদ্দেশ্যে তাঁর সময়ই স্থাপিত হয়েছিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম)। বঙ্গবন্ধুর তৈরি করে যাওয়া সেই প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেডিসিনকে নিয়ে গেছেন সোসাইটির দোরগোড়ায়। প্রতি ছয় হাজার জন মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় সাড়ে তিন শটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে উন্নীত করা হয়েছে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় আর দেশের হাসপাতালগুলোয় শয্যাসংখ্যা এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে দেড় লাখ।

আর দেশে যে কতগুলো নতুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আর বিশেষায়িত চিকিত্সা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে প্রসঙ্গ না হয় না-ই টানলাম। আমি শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে যাওয়া পথে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের যে ভবিষ্যত্টা দেখি, স্বাস্থ্য খাতের একজন পেশাজীবী হিসেবে আমি তাঁর উন্নতির শিখরটা একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।

লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
-অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্ট,
-নির্বাহী সভাপতি,বঙ্গবন্ধু  গবেষণা সংসদ। 

 

মুক্তআলো২৪.কম