কুতুবুল আলমদের সেকাল-একাল:ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০১:২৫ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

অধ্যাপক ডা.মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল :স্মৃতিচারণমূলক লেখালেখির ব্যাপারে প্রচলিত চলটি হচ্ছে কোন বিশিষ্ট প্রয়াত ব্যক্তির সম্বন্ধে তার কাছের কিংবা প্রিয়ভাজনরা তার মৃত্যুর পর তার সম্বন্ধে ভালো-মন্দ পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরবেন। প্রয়াত কুতুবুল আলমের সাথে আমার সেরকম কোন সম্পর্কই নেই। না আমি ব্যক্তিগতভাবে তার পরিচিত, না তার আত্মীয়। অতএব কুতুবুল আলম সম্বন্ধে স্মৃতিচারণের ক্রাইটেরিয়া আমি পূরণ করিনা। তারপরও প্রয়াত এই গম্ভীরা শিল্পী সম্বন্ধে লেখার প্রস্তাবটা সানন্দে গ্রহণ করেছি। কেন, আসছি সে প্রসঙ্গে।


কুতুবুল আলমের সাথে আমার পরিচয় বিটিভির সে সময়কার সাদা-কালো পর্দায়। নাচে-গানে-ছন্দে ‘নানা-নাতি’ কি অদ্ভুত দক্ষতায়ই না সমাজের নানা অসংঙ্গতি আর সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। কুতুবুল আলম প্রয়াত হয়েছেন দীর্ঘ দিন, কিন্তু ছেলেবেলার সেই স্মৃতি এখনো আমার স্মৃতিপটে জ্বলজ্বলে।


সম্প্রীতি বাংলাদেশের সুবাদে ইদানিংকালে আমার দেশের এমাথা থেকে ওমাথায় যে ছুটে চলা, সেই সুবাদে ক্রমেই বাড়ছে আমার পরিচিতজন, বন্ধু আর সুহৃদ। সারাদেশ জুড়ে কত লোক যে কত কিছুই না করছেন একাত্তরের চেতনায় একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, তা নিজে না বেরুলে কখনই জানতে পারতাম না। তেমনি একজন সুজাতুল আলম কল্লোল, প্রয়াত কুতুবুল আলমের সন্তান। দেশের উত্তরের জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জে সম্প্রীতি বাংলাদেশের সাংগঠনিক ভীতটাকে মজবুত করায় খেটে চলেছেন। সেভাবেই পরিচয় তার সাথে। বাবার মতই তিনিও একজন সচেতন সংস্কৃতিকর্মী।


গত জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারে সম্প্রীতি বাংলাদেশের জনসভা শেষে তাকে গম্ভীরার নাচে-গানে-ছন্দে মাতাতে দেখেছি হাজার পাঁচেক উপস্থিতিকে। কি সহজ ভঙ্গিতেই না ডাক দিয়ে গেলেন আসন্ন নির্বাচনে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে আরো একবার নির্বাচিত করার। আবার তাকেই দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে এসে আমাদের মনে করিয়ে দিতে কোথায় কোথায় আমরা আমাদের রোগীদের প্রত্যাশাগুলো পুরোপুরি পূরণ করতে পারছি না, তাও সেই গম্ভীরারই ছন্দে-নাচে।


কুতুবুল আলমের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে ‘ধান ভাঙতে শীবের গীত গাওয়ার’ উদ্দেশ্য একটাই। কল্লোলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমি বহু বছর আগে বিটিভির সাদা-কালো পর্দায় দেখা তার প্রয়াত পিতার ছায়া দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধে কুতুবুল আলম হারিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে। সেই গভীর বেদনাকে হৃদয়ের গভীরে ধারণ করে গম্ভীরার ছন্দে-গানে তিনি আমরণ কাজ করে গিয়েছেন এদেশটাকে আরেকটু অসাম্প্রদায়িক আর আরেকটু প্রগতিশীল করার চেষ্টায়।


পঁচাত্তরের পর থেকে একুশটি বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এদেশে ক্ষমতার শীর্ষে ছিল পাকিস্তানপন্থী ‘বাংলাস্তানীরা’। সে সময়ে এদেশের গৌরবের আরো অনেক কিছুর সাথে সাথে বিস্মৃতির অন্তরালে ঠেলে দেয়া হয়েছিল আমাদের একান্তই নিজস্ব ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোকেও। একটি জাতিকে তার নিজের পরিচয় ভুলিয়ে দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো কোন পন্থা সম্ভবত আর হতে পারে না। অন্ধকার সেই একুশটি বছরে হারিয়ে গিয়েছিল যেমন একাত্তর, তেমনি হারিয়ে যেতে বসেছিল আমাদের গম্ভীরা-পটের গান-কবির লড়াই-পুঁথিপাঠ। আর বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতির এই শূন্যস্থানগুলো একে একে পূরণ করেছিল প্রিন্সেস রিনা খানদের ঝুমুর ঝুমুর নৃত্য আর সব শেষে ক্যাসিনো। প্রিন্সেসদের দাপটে গম্ভীরার জায়গা হয়েছিল হেমন্তের কাটা ধানের মাঠ ছেড়ে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের বড় দালানে।


আজ আমরা যখন মুজিব বর্ষ আর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে, জাতি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতির ইতিহাসে সবচাইতে বড় উদযাপনের, তখন কুতুবুল আলমদের অভাবটা খুব বেশি করে অনুভূত হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হারালেও আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন তার দুই কন্যা।


একুশ বছর পর শেখ হাসিনার হাত ধরে দেরিতে হলেও সঠিক গন্তব্যে এখন বাংলাদেশের গর্বিত যাত্রা। ইতিহাস ফিরতে শুরু করেছে ইতিহাসের সঠিক জায়গাটায়। তবে আগামীর এই নতুন বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িকতা আর একাত্তরের চেতনার একটা শক্ত ভীতের উপর পাকাপাকিভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে হলে এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আজকের প্রজন্মের কুতুবুল আলমদের আরো বেশি দৃশ্যমান হওয়াটা বড্ড বেশি প্রয়োজন।

১৪ ডিসেম্বর ছিল কুতুবুল আলমের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।