শর্মিষ্ঠা ঘোষ এর অনুগল্প- `টিকটিকি`

ভারতের উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকেঃশর্মিষ্ঠা ঘোষ

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৯:৪৫ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বুধবার | আপডেট: ১০:০১ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বুধবার

সোনাই কে দেখেই  ভিড়টা গা টেপাটেপি করতে লাগলো … উচ্চকিত কয়েকটা গলা সহসা সন্দেহজনক ফিসফাসে পর্যবসিত হল ... আসছে আসছে ... কেউ ফিরে তাকাল , কেউ ঠোঁট উল্টালো , কেউ করুণার হাসি ঝুলিয়ে রাখল ঠোঁটে । সোনাই বুঝতে পারে এই হাস হাস ম্যানারিসম এর মানে ... বুঝতে পারে হাটে বাটে ঘাটে সে এখন সবার আলোচনার বস্তু ।  সে শুধু নয় , তাদের গোটা ফ্যামিলিটাই তাই । কেউ কেউ পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছিল বটে , কিন্তু মানস বসুর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন বসতেই সব বুদবুদের মত হাওয়া । মিনিস্টার চামচে ধামাধরা কাউকেই এখন আর ত্রিসীমানায় দ্যাখা যাচ্ছে না । আত্মীয় স্বজনরাও ফোনাফুনি বন্ধ করে দিয়েছে । বন্ধুবান্ধব দু চারটে এসেছিল প্রথম প্রথম , বাড়িতে তখনও ঢিল পড়া শুরু হয় নি , দরজায় দেয়ালে তখনও আলকাতরা ল্যাপা হয় নি , বাজারে গ্যালে তখনও দোকানি না চেনার ভান করে না । মিডিয়ার কল্যাণে নিউজ টা যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো , তত নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে লাগলো । মালতি ঘর মোছা , বাসন মাজার ফাঁকে ফাঁকে কিছুমিছু শুনেছে পারিবারিক কথোপকথন । বারে বারে মা আর ছেলে , বাপের দিকে আঙ্গুল তুলেছে , ‘কেন , কেন , কেন ?’ কি , কেন তা অবশ্য মালতি পরিষ্কার বুঝতে পারে নি ।  তারপর যেদিন রাজপথে বিশাল মিছিল বেরিয়ে গ্যাল , হায় হায় করতে করতে , বুঝল দাদাবাবু সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা করেছে ... কোন মেয়ের সম্মানহানীর মত গুরুতর কিছু । ও ভেবে পায় নি , দাদাবাবুর আবার মেয়েমানুষের দোষ হতে যাবে কেন ! বৌদি যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী । ছেলেও কত বড় হয়ে গ্যাছে । ছেলেই তো হবু বউকে মাঝে মাঝে বাড়ি নিয়ে আসে । দাদাবাবু কে তো দেখেছে , দিনরাত্তির বই মুখে বসে থাকতে । হঠাৎ এ কোন ভীমরতি হল , তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকার পরে ? ও যাদের সাথে একসাথে রোজ ট্রেনে করে আসে , সবাই ওর কাছে আরও বিশদ জানতে চায় ! বউদির রিয়াকশান বিশেষ করে , মালতি ঠারেঠোরে যা বুঝেছে , বউদি বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইছে ছেলে  নিয়ে । দাদাবাবু খালি পা ধরতে বাকি রাখছে । স্কুলে যাচ্ছে না কদিন ধরে । নাকি অসুস্থ । অসুস্থ না ছাই ! বাড়ি বসে সারা দিনরাত কাকে কাকে ফোন করে আর দোষারোপ করে , আড়ি পেতে শুনে মালতি বুঝেছে , দাদাবাবুকে কেউ গাছে তুলে মই কেড়ে নিয়েছে । কোন পার্টি থেকে কেউ বলেছিল ম্যানেজিং কমিটির নাম করে কোন একটা কাজ করে দিতে , তারপর দাদাবাবু ফেঁসে গ্যাছে । কারণ মাঝখানে একটা মেয়ে কি করে ঢুকে গ্যাছে । পুলিশ কেস হয়ে যেতে পারে যখন তখন । মিডিয়া আর মানবাধিকার কমিশান মেয়েটির বাপ মাকে নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ী করছে । বলেছে পুলিশ এফ আই আর না নিলে রাজ্যপালের কাছে নিয়ে যাবে ওদের । দাদাবাবু কাকে যেন একদিন বলছিল , ‘আমি তো আপনার কথা রেখেছি , এবার আপনারা কিছু করুন ! আমি তো মুখ দ্যাখাতে পারছি না । সবাই ছি ছি করছে ! একটা মিটিং মিছিল কিছু তো করুন আমার সমর্থনে ! আমাকে তো আত্মহত্যা করতে হবে এইবার !’

সোনাই কলেজ যাবে না ভাবছে কিছু দিন । এত টেনশান আর নিতে পারছে না । এত লজ্জা আর সহ্য হচ্ছে না । স্নেহাও কেমন গা ছাড়া আচরণ করছে । স্নেহার ব্যাচমেট ঐ মেয়েটির কথা সোনাই পেপার পড়েই প্রথম জেনেছে । বাবাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় সোনাই । বাবা কি জানতো না , মিডিয়া আজকাল কত ধারালো ? বাবা কি সত্যি ই মেয়েটাকে ... ? মেয়েটার বয়েস ভাঁড়ানো না থাকলে মেয়েটা সোনাই এর বয়সীই হবে । সোনাই এর মাসতুতো বোন সোনাই এর পিঠোপিঠি । বাবা কি ওকেও কোনোদিন ... ? সোনাই ধন্ধে পড়ে যায় । এই বাবাই তো ছোটবেলায় ঘুম না এলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত , এই বাবার হাত ধরেই তো সোনাই পার্ক , চিড়িয়াখানা , পুজো প্যান্ডেল করেছে । মা তুলনায় গম্ভীর । মা বকা দিত । মা শাসন করতো । মা খুব রেগে গ্যালে বাড়ি থেকে বের করে গেট ও লাগিয়ে দিয়েছিল একবার । মানুষ কি বদলে যায় ? মানুষের ভেতরে আসলে কটা মানুষ থাকে ? মানুষের সুনামে কালি ছিটতে কটা মুহূর্ত লাগে ? আর সেই মানুষ টার কেউ হওয়া যে কি বিড়ম্বনার তা সোনাই ছাড়া কে বুঝবে ভালো ? কি যে করে এখন সোনাই ? স্নেহাকে ফোন করলে বেজে যায় আজকাল । কলব্যাক করে না । ওর মা কি ভাববে ভয়ে ওদের বাড়িও যেতে পারছে না সোনাই । রাতের বালিশ জানে , আঠেরো বছরের ছেলের কান্নার শব্দ কি কুৎসিত । রাতের অন্ধকার জানে , আঠেরো বছরের ছেলের একা লাগার ক্ষণে স্বমেহনের ইতিহাস । সোনাই পালাবে বাড়ি ছেড়ে । কোথায় ? মামাবাড়ি ? মায়ের সাথে ? দিদুন আর মামা কিছু বলবে না হয়তো । কিন্তু মামী আর বুনাই ? মুখটিপে হাসবে না ওরা ? এমনিতেই সোনাই এর ইস্কুল মাষ্টার বাবার প্রোফাইল এ বাড়ির তুলনায় বেশ লো ই বলতে গ্যালে । ওদের করুণার পাত্র হতে হবে শেষমেশ ? সোনাই আর ভাবতে পারে না । জল গড়ান চোখের কোলে শ্রান্তির ঘুম নেমে আসে । স্বপ্নে স্নেহার সাথে দ্যাখা হয় । স্বপ্নে স্নেহাকে জাপটে ধরে চুমু খায় সোনাই । ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত হয়ে যায় ।

সুমনার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না মানস । মানসের মাথার ঠিক নেই । ঘুম নেই । খাওয়া নেই । খুব খুব আশা করেছিল , সুমনা অন্তত পাশে থাকবে । সুমনা অন্তত জানতে চাইবে , সত্যিটা কি ? সুমনা অন্তত ওর বুকে মাথা গুঁজতে দেবে মানস কে । বলবে , ‘সব ঠিক হয়ে যাবে । বলবে , আমি আছি তো । বলবে , আমি জানি , তুমি কোন অন্যায় করতে পারো না কখনো’। কিন্তু কই ? একদিনও তো কাছে এসে বসলো না । একদিনও তো রাতের অন্ধকারে উঠে এলো না নির্ঘুম মানসের শরশয্যায় । একদিনও তো মানসের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠে বলল না , ‘আমি আর পারছি না গো’! সংসারটা কি দস্যু রত্নাকরের মত , কেউ কারও দায় নেবে না ? স্ত্রী না , পুত্র না , ভাগ্যিস বাবা মা বেঁচে নেই । থাকলে কি হত আজ ভাবতেও পারে না মানস । আজ ডক্টর দত্ত এসেছিলেন । যদিও উনি হেসে হেসেই কথা বলছিলেন , মানসের মনে হচ্ছিলো , উনি ও যেন বিশ্বাস করেন এসব । মানস সিটিয়ে ছিল সমস্ত ক্ষণ । এই বুঝি উনি ঐ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন । মানস অবশ্য বলতেই চায় । একমাত্র তবেই ও হাল্কা হতে পারবে । কিন্তু ও যাকে বলতে চায় , সে শুনতে চায় কই ? আর ছেলে ? ছেলেটাও কি ঘেন্না করছে ওকে ? না হলে একবারও বাবা ডাক টা উচ্চারণ করে না কেন ? একবারও বাবার সামনে এসে বলে না কেন , সত্যি টা কি ? বরং মা আর ছেলের আলোচনায় বারবার উঠে আসে প্রশ্নটা , কেন , কেন , কেন ? উনি কতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে গ্যাছেন । দোকান থেকে এক পাতার বেশী দ্যায় নি । কি করবে মানস ? আরও কতগুলো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে জমাবে ওষুধগুলো ? পর্যাপ্ত জমে গ্যালেই ... ? তদন্ত কমিটির মাথায় বসে আছে যে এস পি , এক কালে এক প্রাইমারীতে পড়েছে মানসের সাথে । খুব একটা ভাব ভালোবাসা ছিল না । কে জানে চিনবে কিনা । মানস মাথার চুল ছেঁড়ে বসে বসে । মানস হাত কামড়ায় । কেন যে বিশ্বাস করতে গ্যাল ওদের ? কেন যে রাজী হয়ে গ্যাল এক কথায় ? মানস চিন্তা করেছে । সেটা আসলে কি ? পার্টির প্রতি আনুগত্য ? নাকি লোভ ? গুলিয়ে যায় । আয়নাটা ঝাপসা এতো । শুধু আয়নাকে দোষ দ্যায় না মানস । কাউকেই কি দ্যায় । কেউ কি ছিল ? কেউ কি থাকে ? মানসের ? সুমনার ? সোনাই এর ? নাকি ... ? দেয়ালে টিকটিকিটা বিচ্ছিরি ভাবে বলে ওঠে ‘টিক টিক টিক...’।