প্রিয়বাংলার পথমেলায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস!

ওয়াশিংটন ডিসি থেকেঃ আব্দুস সাত্তার

মুক্ত আলো

প্রকাশিত : ০৩:৩৪ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ শনিবার | আপডেট: ০৫:২০ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ শনিবার

বর্ণাঢ্য আয়োজন আর হাজারো মানুষের বাঁধ ভাঙা আনন্দ-উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার আর্লিটনে ১৩ সেপ্টেম্বর শনিবার উদযাপিত হয় এক ঝাঁক মেধাবী তরুণদের সংগঠন `প্রিয়বাংলা`র আয়োজনে তৃতীয় বারের মত ঝমকালো পথমেলা। সেই সাথে শেষ হল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক মিলন মেলার জন্য হাজারো মানুষের বছরব্যাপী প্রতীক্ষা।  

বৃষ্টি বিঘ্নিত মেলা ঠিক সময়ে শুরু হতে না পারলেও ঠিক বিকাল দুটো সময় নিউ ইয়র্ক থেকে উড়ে যাওয়া বুলবুল হাসানের দরাজ গলা বাংলা এবং ইংরেজিতে বলে উঠলেন, `সম্মানিত সুধী, আজকের এই প্রিয় বাংলার প্রিয় পথমেলায় আপনাদের স্বাগতম!` বুলবুলের বাংলা ও ইংরেজি উপস্থাপনা কেড়ে নেয় সকলের হৃদয়। যেমন তার বাংলা, তেমনি তার ইংরেজি কথার ফুলঝুরি। 

পথমেলার আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমেরিকায় বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড জিয়া উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য প্রবাসে বাঙালি সংগঠনগুলোকে আরও বেশি কাজ করার উদাত্ত আহবান জানান তিনি।

মেলার গ্র্যান্ড স্পন্সর পিপলএনটেক ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিফ বলেন, "প্রিয় বাংলার পথমেলা পুরো বাংলাদেশী-আমেরিকাদের একটা ভিন্ন আমেজ দিয়েছে। এত প্রাণ আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র আর কোন মেলায়, কোন অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। আর তাই পিপলএনটেক প্রিয় বাংলার সাথে আছে সবসময়। ওয়াশিংটনে বিভিন্ন দেশের শিল্পী ও সংগঠন এখানে পারফর্ম করার সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়। সংস্কৃতির পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আবু হানিফ সকলের প্রতি তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হওয়ার পরামর্শ দেন।"

তিনি আরও বলেন, " পিপলএনটেক মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রী আইটি কোর্স দিয়ে থাকে। আমাদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশী ৫০০ টিওর বেশী সংগঠনকে প্রিতিবছর একটি করে ৫০০ টিরও বেশি স্কলাশীপ দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান প্রায় তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে আইটি প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকুরী দিয়েছে যাঁদের বেতন ৮৫ হাজার থেকে দেড় লাখ ডলার।" বাংলাদেশীসহ বিশ্বের সব মানুষকে আইটি সেক্টরে প্রশিক্ষিত করে অড জব থেকে মুক্তি দিতে  পিপলএনটেক বদ্ধ পরিকর বলেও তিনি জানান তিনি।মেলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক উৎসব ডট কম বিনা পয়সায় প্রতি ঘন্টায় লটারির মাধ্যমে পুরস্কার বিতরণ করে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে রাখেন। 

মেলার আরেক পৃষ্ঠপোষক  নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ম্যাস মিউচুয়াল ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের ফিনান্সিশিয়াল সার্ভিসেস প্রফেশনাল শাহ ফিরোজ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, প্রিয়বাংলা পথমেলা মানুষের মাঝে একটি  ভিন্ন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। আর এ কারণেই এমন একটি আয়োজনের সঙ্গে  এ বছর রয়েছে ম্যাসমিউচুয়াল।` প্রতিবছর প্রিয়বাংলার এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

একুশে টিভি যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলের সি ই ও আসমা করিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, "একুশে টিভি এ ধরণের সাংস্কৃতিক বিকাশে সকল কর্মকাণ্ডের সাথে সব সময় আপনাদের পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।" তিনি প্রিয়বাংলার বর্ণাঢ্য আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এছাড়াও প্রিয়বাংলা পথমেলার প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে এবারে বার্তা পাঠিয়েছেন কমন অয়েলথ অব ভার্জিনিয়ার প্রধান Terence R. McAuliffe। তিনি এই পথ মেলাকে ` বাঙালি মেলা` বলে উল্লেখ করেন। তিনি তাঁর দেয়া স্বীকৃতি সনদে উল্লেখ করেন, "কমন অয়েলথ অব ভার্জিনিয়া প্রিয় বাংলা পথমেলাকে অফিশীয়ালি `বাঙালি উৎসব` হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে`।" 

তিনি তাঁর লেখায় এই পথমেলাকে `সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে` এক অসামান্য অবদান বলে উল্লেখ করে ভার্জিনিয়ার সকল শ্রেণীর মানুষকে পথমেলায় সক্রিয় অংশগ্রণ করে “Let’s Celebrate the Cultural Diversity” এই মূলসুরকে আরও অর্থবহ করে তোলার উদাত্ত আহবান জানান। প্রিয় বাংলার এই `বাঙালি উৎসব` ভার্জিনিয়ার বাঙ্গালি-আমেরিকান কমিউনিটির জন্য একটি বৃহৎ পরিসরের একটি সুযোগ, যার সক্রিয় কার্যক্রম এবং অবদান ভার্জিনিয়ার অর্থনীতিকেও আরও সমৃদ্ধ করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেন্ট্রাল এশিয়া বিষয়ক সহকারী নিশা ডি বিসওয়াল, ভার্জিনিয়ার সিনেটর মার্ক আর ওয়ার্নার,  প্রতিনিধি সভায় ভার্জিনিয়া অষ্টম ডিস্ট্রিক্টের সদস্য ও কংগ্রেস সদস্য জেমস পি মোরান, প্রতিনিধি সভায় ভার্জিনিয়া একাদশ ডিস্ট্রিক্টের সদস্য ও কংগ্রেস সদস্য জেরাল্ড ই কোনোলি, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেন মজিনা প্রমূখ। 

বাংলাদেশি-আমেরিকান শিশু, কিশোর, নারী এবং পুরুষদের পাশাপাশী পৃথিবীর শতাধিক দেশের মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক পরে অংশ নেয় তাঁদের বহু প্রতীক্ষিত এই পথমেলায়।

আর তাই সকাল থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুপুর ১২টার পূর্বেই মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে রবি ঠাকুরের, `ঠাই নাই, ঠাই নাই ছোট সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।" এই `সোনার ধান` যেন সারা পৃথিবীর দুশটিরও বেশী দেশের মানুষের মিলন মেলা। প্রিয় বাংলার পথমেলা হয়ে উঠে `আন্তর্জাতিক মেলায়। কানাডা, মেক্সিকো, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা, চীন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, ইংল্যান্ড, আফ্রিকা, ব্রাজিল, আরজেন্টিনা,  বলিভিয়া সহ শাতাধিক দেশের মানুষের এ যেন এক মিলন মেলা। 

বাঙ্গালি-আদিবাসীসহ অনেক বিদেশিদের আনাগোনায় মেলা হয়ে উঠে বর্ণিল, রঙিন। আমেরিকানদের কেউ কেউ পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনের আনন্দে ঢুকে পড়ছিলেন বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে। অনেক আমেরিকানকেই নাচতে দেখা যায় নৃত্য আর গানের ছন্দে এবং তালে! 

প্রিয়বাংলার এই আয়োজনে ছিলো আন্তর্জাতিকতার প্রাণের ছোঁয়া। তা প্রমাণ মেলে সাংস্কৃতিক মঞ্চে উপস্থাপিত বক্তৃতা, গান, নাচ এবং বিচিত্র পরিবেশনা থেকেই। বাংলা নাচ আর গানে র পাশাপাশি চীন, বলিভিয়া, স্পেন, মেক্সিকো, আফ্রিকা, আমেরিকান শিল্পীরা বিচিত্র রকমের গান, নাচ, আবৃত্তি, যন্ত্র সংগীত, ফ্যাশন শো পরিবেশন করেন।

এবারের মেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য এবং অনবদ্য দিক ছিল তৃপ্তি চিসিম মনির কোরিওগ্রাফিতে গারো আদিবাসী শিশু শিল্পী আসকি চিসিম, পালকি চিসিম ও দুলকি চিসিম এর পরিবেশনায় অনিন্দ্য গারো আদিবাসী নৃত্য। আইওম গিসি রাআতা গানের ছন্দে পুরো পথমেলার দর্শক-আয়োজকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে এই গারো আদিবাসী শিশু শিল্পীরা।  

বলিভিয়ার ফ্রাটার্মিডাড কালচালার পাচা-মামা, মেক্সিকোর লজ কোয়েজালেস মেক্সিকান ড্যান্স,  সোফিয়াস পারফর্মিং আর্ট সেন্টার, কুকোয়া আফ্রিকান ড্যান্স, এ্যালিউর ড্যান্স ডিসি ছাড়াও আরও অনেক সংগঠনের নৃত্য পরিবেশ না। এসব একের পর এক পরিবেশনা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে সারাবেলা।

বিকেল চারটার পর মেলায় মানুষের ভিড়ে হাঁটার সমস্যা দেখা দেয়। তিল ধারণের জায়গাটাও ছিল না আর। মেলা প্রাঙ্গন আরও জমজমাট হয়ে উঠে। মেলাপ্রাঙ্গণের দু`পাশে বিভিন্ন সংগঠন, সমিতির দেওয়া স্টলগুলোতে কোথাও শাড়ি, পাঞ্জাবি, কোথাও দেশি সালোয়ার কামিজ, বিভিন্ন ধরনের গয়না, বাচ্চাদের জন্য খেলনা, শো-পিস সবকিছুরই পসরা বসে যায়। সঙ্গে ছিলো বিরিয়ানি, চটপটি ফুচকাসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি খাবারের পঞ্চাশেরও অধিক খাবারের দোকান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চলছিলো বক্তৃতা, সংবর্ধনা, সম্মাননার আয়োজন। আমেরিকান সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য সাত জন কে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সমাজে অসামান্য অবদানের জন্য ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিপ, সি ই ও, পিপল এন টেক (আইটি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য); আসমা করিম, সি ই ও ই টি ভি (যুক্তরাষ্ট্র), ফকরুল আলম লিটন, টেরিটরি কো-অরডিনেটর, ইটিভি, দস্তগীর জাহাঙ্গীর (সাহিত্য  ) ;  আব্দুস সাত্তার, ম্যানেজিং এডিটর, সাপ্তাহিক এখন সময় (সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়)  বাবুল ডি` ন ক রেক, চীফ নিউজ এডিটর নিউজ-বাংলা ডট কম (সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়) প্রমুখদের এই সম্মাননা দেয়া হয়।    

সবশেষে ছিল কণ্ঠশিল্পী মারিয়া কস্তা, এস আই টুটুল এবং গণসঙ্গীত শিল্পী ফকীর আলমগীর সহ স্থানীয় শিল্পীদের মনমাতানো গান। 

প্রিয়বাংলা পথমেলা আয়োজক দলের অন্যতম প্রধান প্রিয়লাল কর্মকার বলেন, একটি মেলার স্বার্থকতা তার দর্শণার্থীদের ভালোলাগার মধ্য দিয়ে। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আশা করি ভবিষ্যতে আরও ভালো করে এর আয়োজন করতে পারবো। মেলার শেষে তিনি মেলার টাইটেল স্পন্সর ঢাকা হোম অ্যান্ড এনআরবি ক্যাপিটলের সিইও বেলায়েত হোসেন, ম্যাসমিউচুয়াল  এর শাহ ফরিদ, পিপলএনটেক এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সি ই ও ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিফ সহ যারা আর্থিক অনুদান দিয়ে অনুষ্ঠানটিকে সুন্দর এবং স্বার্থক করে তুলেছেন তাঁদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।   

তিনি বলেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এমন একটি আয়োজন সফল হয়েছে প্রিয়বাংলা পথমেলার সেই ব্যবস্থাপনা দলে ছিলেন শিবলী সিরাজ, জীবক বড়ুয়া, ফারহানা হানিফ, প্যাট্রিক গোমেজ, রুম্পা বড়ুয়া, আমিনুল ইসলাম রনিম, খালেদ চৌধুরী, নুপুর চৌধুরী, বনানি চৌধুরী, রূপক বড়ুয়া ও বাণিব্রত ঘোষ। নির্বাহী দলে ছিলেন মৌসুমি ফাতেমা সিরাজ, পুলি কর্মকার, পীযুষ বড়ুয়া, দুলাল রায়, মিতালী গোমেজ, দিপ্তী বড়ুয়া, জুয়েল বড়ুয়া, আলতাফ হোসেন, উজ্জল বড়ুয়াও সেলিম আখতার সহ আরও অনেকেই।

মিডিয়া এক্সিকিউটিভ হিসেবে ছিলেন সফি দেলোয়ার কাজল, আবদুস সাত্তার, বিপ্লব দত্ত ও বাবুল ডি` নকরেক প্রমুখ । তিনি প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা জানান। 

তথ্য: বাবুল ডি` নকরেক